পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ৩১ মে, ২০১২

কাকিসটোক্র্যাসির রাজত্ব


॥ আলমগীর মহিউদ্দিন ॥

Where people fear the government you have tyranny. Where government fears the people you have liberty- John Basil Barnhill (1914)
Government is not reason, it is not eloquent; it is force. Like fire, it is a dangerous servant and a fearful master- George Washington.
এ উদ্ধৃতি দু’টি নিয়ে আলোচনার আগে একটি ক্ষীণ সম্পর্কিত বিষয় লক্ষ করা যেতে পারে। কারণ, শিরোনামের সাথে এর যোগসূত্র রয়েছে। বিষয়টি হলো ভারতের সাবেক সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ও বর্তমানে ভারতীয় প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জাস্টিস মারকান্ডে কাটজুর বক্তব্য। তার পুরনো বক্তব্যগুলোর মতোই ভারতীয় পত্রপত্রিকা ও বোদ্ধা জনগণের মধ্যে এবারের বক্তব্যটিও ঝড় তুলেছে। জাস্টিস কাটজু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘ভারতের ৯০ শতাংশ মানুষ মানসিকভাবে পিছিয়ে আছে।’ তিনি তাদের ‘বোকা-গাধা (idiot, fools) বলেছেন। তিনি বলেছেন তাদের মানসিকতা ‘যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত’ না হওয়ায় তাদের মন ‘বর্ণপ্রথা, সাম্প্রদায়িকতা ও কুসংস্কার’ (Casteism, Communalism and Superstition) আচ্ছন্ন করে রাখে। ফলে ুদ্র স্বার্থবাদী এবং ক্ষমতালোভীরা তাদের সহজেই ব্যবহার ও পরিচালিত করতে পারে। তার মতে, ভারত এ জন্য ক্রমেই পেছনে পড়ে যাচ্ছে এবং তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, একসময় ভারতের অস্তিত্বেই হয়তো হাত পড়বে। তিনি এ স্বার্থবাদীদের অযোগ্য এবং অপরাধীর সাথে তুলনা করেছেন। কয়েক দশক ধরে এমন মানুষেরা প্রায়ই গদি দখল করছে। এমন শাসকদের কারণে ভারতে সামাজিক বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছে। তাদের নিয়ে তিনি মজার উদাহরণও টেনেছেন। ‘শতকরা ৯০ ভাগ ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র দিয়ে ভাগ্য গণনায় বিশ্বাসী।’ তিনি জ্যোতিষীদের ‘ধাপ্পাবাজ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন’ (humbug and superstitious) বলে অভিহিত করে প্রশ্ন করেছেন, গ্রহগুলো কেমন করে জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? তিনি দেখিয়েছেন, যে টিভি যত জ্যোতিষচর্চা করে, তার টিআরপি (দর্শকপ্রীতি) তত বেশি।
ক্রিকেটের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এখন এটাকে সংবাদমাধ্যম ও ব্যবসায়ীরা ধর্মের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আফিমের নেশায় যেন জনগণকে বুঁদ করে ফেলেছে। অথচ ৮০ শতাংশ লোকের সমস্যা হলো দারিদ্র্য, চাকরি, খাদ্য, পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও বাসস্থান। এ নিয়ে এরা মাথা ঘামাচ্ছে না।
আবার আন্না হাজারের বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের মাতামাতিকে তিনি ম্যাকবেথের সেই বিখ্যাত উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘এগুলো মাত্র বাগাড়ম্বর। আসলে দুর্নীতির গায়ে কোনো স্পর্শ লাগেনি।’ (a tale/told by an idiot, full of sound and fury/signifying nothing) জাস্টিস কাটজু তার স্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে মাঝে মাঝে ঝড় তোলেন। বিশেষ করে ভারতীয় সাংবাদিকদের ‘মেধাহীন লেজুড়বৃত্তিকে’ তীব্র কশাঘাত করে মন্তব্য করেছেন, তাদের বেশির ভাগই ‘নিম্নমানের বুদ্ধিজীবী’। তিনি বলেছেন, ক্ষমতায় অপরাধী এবং অযোগ্যদের বিশাল উপস্থিতি সমাজের সর্বস্তরে তার প্রভাব পড়ছে।
তবে জাস্টিস কাটজুকে সমর্থন না করেও বিশালসংখ্যক ব্লগার একটি মূূলসুরকে নিয়ে আলোচনা করেছে। তারা বলেছে, বেশ কয়েক দশক ধরে ‘অযোগ্য ও অপরাধীরা’ জনগণকে বোকা বানিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে তাদের চিরাচরিত তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে। তাদের প্রচারণা ও নিষ্পেষণের যাঁতাকলে জনগণকে এতই ব্যস্ত রাখা হচ্ছে যে, তারা তাদের সাধারণ চিন্তার অধিকারটুকু হারিয়ে ফেলছে। তারা গতকাল বা আগামীকালের ভাবনার মাঝে ফাঁকটুকু পাচ্ছে না আজকের জীবনে।
আসলে এ অবস্থা এখন তীব্র হলেও এর অবস্থান খুব পুরনো। আর তাই কয়েক শতাব্দী আগেও এমন অবস্থার বর্ণনা মেলে। এমন সরকারকে বলা হয় কাকিসটোক্র্যাসি। এমন সরকারগুলোর দাপট ও তাণ্ডবতা তীব্রতা লাভ করে তত, যত তাদের ব্যর্থতার বোঝা। এখন এ বিষয় নিয়ে বিকল্প সংবাদমাধ্যম এবং বোদ্ধা প্রতিবাদী রাজনৈতিক অঙ্গনে এর বিশাল আলোচনা চলছে। এ বিষয় নিয়ে আলোচকেরা এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন যে, প্রথম বিশ্বের নেতৃত্বে সারা বিশ্বে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে এখন কাকিসটোক্র্যাসির রাজত্ব চলছে। এবং জনগণকে অবধারিতভাবে এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে। এমন অভাবিত ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে যে, মানুষের অনুভূতি হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠবে, বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে কাকিসটোক্র্যাসি কী? উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞা অনুসারে এটা ‘অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীদের’ সরকার। এটা গ্রিক শব্দ ‘কাকোস’ অর্থাৎ খারাপ (bad) থেকে এসেছে। কাকোসের বহুবচন কাকিসটোস অর্থাৎ ‘অত্যন্ত খারাপ’ (worst)।
এমন সরকারের সংজ্ঞা আগে থাকলেও ১৮২৯ সালে ‘মিসফরচুন অব এলফিন’ উপন্যাসে থোমাস লাভ পিকক প্রথম লিখিতভাবে শব্দটি ব্যবহার করেন। এরপর ১৮৭৬ সালে ব্যঙ্গাত্মক লেখক জেমস রাসেল লোয়েল তখনকার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এক চিঠিতে প্রশ্ন করেছিলেন, আমাদের সরকারটি জনগণের (Is our government of the people, by the people, for the people or a Kakistocracy rather, for the benefit of Knaves at the cost of fools?) নাকি শয়তানের (Knave) স্বার্থে, যারা বোকা জনগণকে জিম্মি করেছে (at the cost of fools)। মার্কিন নিবাসী অতনু দে ভারতের কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন, যখন সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ ও নৈতিকতাহীনদের (most corrupt and least principled) কাকিসটোক্র্যাসির সরকারের বলা হয়, তখন ভারতের উদাহরণটি আসে সর্বাগ্রে। অথচ ভারত বিশ্বের মধ্যে অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ বলে পরিচিত।
উইকিপিডিয়ার মতে, নানা সময়ে ৩২ ধরনের সরকার চালু ছিল, যদিও সাধারণ মানুষ গুটিকয়েক ধরনের কথা বলে থাকে। যেমন গণতন্ত্র। অথচ এপিসটেমোক্র্যাসি, জেনিওক্র্যাসি, লোগোক্র্যাসি, কেপ্টোক্র্যাসি, ক্রিটোক্র্যাসি, থিওডেমোক্র্যাসি, টিমোক্র্যাসি প্রভৃতি সরকার ছিল এবং এখনো চালু আছে ডেমোক্র্যাসির মধ্য দিয়ে। মজার কথা হলো, সরকারের এই নামগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসেছে গ্রিক থেকে, যেখানে প্রথম সরকারের প্রচলন হয়। ডেমোক্র্যাসির জন্মও এখানে। আজ সেই গ্রিস প্রথম বিশ্বে সবচেয়ে রুগ্ণ গণতন্ত্র।
যাই হোক, কয়েক ধরনের সরকার এখন ডেমোক্র্যাসির পৃষ্ঠপোষকতায় কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। যা চলছে তা হলো প্লুটোক্র্যাসি ধনীদের সরকার; টেকনোক্র্যাসি; থিওডেমোক্র্যাসি যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত; ক্রিটোক্র্যাসি বিচারকদের দিয়ে পরিচালিত সরকার। এ সরকার চালিত হয় ক্রিটারকি দিয়ে, যেখানে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকারি কর্মকাণ্ডের জন্য যে রায় দেন; অলিগার্কি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সরকার; অটোক্র্যাসি এবং অ্যানারকি আইন অমান্যকারী সরকার।
খুবই লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রথম বিশ্বসহ দুনিয়াব্যাপী অধুনা ক্রিটারকি চলছে। বিচারকেরা তাদের ক্রিটারকি রায় দিয়ে সরকার পরিচালনা অথবা প্রভাবান্বিত করার কাজে ব্যস্ত। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে কাকিসটোক্র্যাসির নেতারা এমন বিচারক নিয়োগ দেয়, যাতে তারা তাদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। এ জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমন বিচারকেরা দলের সাবেক ক্যাডার বা দলীয় হন। তাদের রায় জনগণকে হতাশ করলেও বোদ্ধা ব্যক্তিরা সহজেই বুঝতে পারেন। এরা সমাজের সোচ্চার প্রতিবাদীদের শক্তি ও বিচারালয়ের অ™ভুত সমন্বয় ঘটিয়ে স্তব্ধ করার প্রয়াস পান। যেমন সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর হামলা এবং অভূতপূর্ব আদালত নির্দেশনা, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নাগরিক অধিকার হরণ করে।
তবে এসবের মূলে কাজ করে ফ্যাসিবাদ যা অবশেষে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করে। কাকিসটোক্র্যাসির শাসকেরা তাদের অযোগ্যতা, দুর্নীতি ও অপরাধকে আড়াল করতে সরকারের সব অঙ্গকে অনৈতিক পন্থায় ব্যবহার করে। এখন এ যুক্তি সর্বগ্রাহ্য যে, সব সরকারই পরিণতিতে কাকিসটোক্র্যাসিতে পর্যবসিত হয়; আবার এটাও বলা হয়, সব সরকারই এ অবস্থা থেকে শুরু করে। পরে তারা ভালো বা খারাপ হয়। সেকুলারিজম প্রবক্তা বিখ্যাত লেখক লরেন্স ডাবলু ব্রিট বলেছেন, এরা সবাই অন্তত ১৪টি পন্থা কম-বেশি ব্যবহার করে ক্ষমতায় যেতে এবং টিকে থাকতে। এগুলো হলো : ০১. আকর্ষণীয় স্লোগান, দেশের পতাকা এবং বিশেষ ধরনের পোশাক পরে তাদের নির্ধারিত জাতীয়তাবাদ তীব্রভাবে প্রচার করে প্রতিবাদীদের স্তব্ধ বা নির্মূল করা; ০২. মানবাধিকারকে নিন্দা করা বা এমন আলোচনাকে প্রতিরোধের চেষ্টা। কারণ, এরা নিজেরাই মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সর্বদা নিয়োজিত থাকে; ০৩. প্রতিবাদ ও প্রতিবাদীকে এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রচারণা শুরু করা এবং নিজেদের অন্যায়-ব্যর্থতাকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া; ০৪. সরকারের সব সশস্ত্র বাহিনীকে নিজেদের রাজনৈতিক মতবাদের আদর্শধারী করা এবং তার জন্য চাকরিচ্যুত, বিচার ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণের ভয় দেখানো বা নেয়া হয়; ০৫. যৌনতাকে প্রগতিবাদের অঙ্গ হিসেবে উৎসাহিত করে যুব সম্প্রদায়কে অনৈতিকতার দিকে ঠেলে দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এবং নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করে ভোগের সামগ্রী হিসেবে অভিহিত করা; ০৬. সংবাদমাধ্যমকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা, প্রয়োজনে বন্ধ করে দেয়া, যাতে জনগণ তাদের অপকর্ম সম্পর্কে কোনো খবর না পায়; ০৭. জাতীয় প্রতিরক্ষা বিষয় নিয়ে প্রচণ্ড মাতামাতি করা এবং এর মাধ্যমে প্রতিবাদী এবং বিরোধী দলকে সম্পূর্ণ নাস্তানাবুদ বা নির্মূল করা; ০৮. শাসকগোষ্ঠী ও ধর্মীয় নেতাদের সমন্বয় সাধন। যেসব ধর্মীয় নেতা এ সমন্বয় কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করবে, তাদের জেলজুলুম ইত্যাদির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল করা; ০৯. করপোরেট শক্তিকে সাহায্য করা; ১০. শ্রমজীবীদের নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাদের সব সংগঠনকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা অথবা নির্মূল করা; ১১. সুশীলসমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ভীতির রাজ্য স্থাপন করা। এ কাজে শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা এবং নিয়ন্ত্রণ করা; ১২. অপরাধ নিয়ে প্রবল প্রচার চালিয়ে নিজেদের অপরাধকে লুকিয়ে রাখা এবং বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে ব্যবহার করা; ১৩. দুর্নীতি নিয়ে প্রচণ্ড আলোচনা ও কর্মকাণ্ডে প্রতিবাদী ও বিরোধীদের শায়েস্তা করা; ১৪. নির্বাচনকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পুলিশ-প্রশাসন-বিচারকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলা।
এ পদ্ধতিগুলো তৃতীয় বিশ্বের কাকিসটোক্র্যাসির অনুসারীরা গণতন্ত্রের নামে নিবিড়ভাবে অনুসরণ করছে। এমনকি প্রথম বিশ্বেও এর ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তাই রেডিও আমেরিকার অনুসন্ধানী রিপোর্টার টিম কেলি সম্প্রতি দ্য পুলিশ স্টেট ইজ হেয়ার নিবন্ধে লিখেছেন, ‘যারা ভাবছেন সুদিন সামনে এবং বিপ্লব এলো বলে, তারা জানেন না রাতের আঁধারে গান গাইতে গাইতে তা চলে গেছে।’ তিনি অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলেছেন।
তবে কেলি যে কর্মকাণ্ডগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন, তা বিশ্বব্যাপী তথাকথিত গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো নিবিড়ভাবে ব্যবহার করছে। যেমন নিবর্তনমূলক আইন, বিরোধীদের বিচারবহির্ভূত শাস্তি এবং নির্মূলকরণ, বিনা চার্জে জেলে প্রেরণ। এমনকি রাষ্ট্রের আইন সাধারণ মানুষের সহায়তায় আসছে না। বরং, সাবেক মার্কিন অর্থসচিব পল ক্রেইগ রবার্টসের মতে, এখন আইন জনগণের রক্ষক নয়, এটা এখন সরকারের হাতের একটি অস্ত্র, যা দিয়ে জনগণকে শায়েস্তা করা যায়।
টিম কেলির একটি মন্তব্য যেন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য করা হয়েছে। ‘দেশের বিচারালয়গুলো যেন পুলিশ স্টেট না ঠেকিয়ে বরং এর বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।’ ('The nation’s courts, rather than checking the police states, relentless expansion, have become its enabler.') কেলি বলছেন, সঙ্গত কারণেই জনগণ এখন সরকারকে ভয় পাচ্ছে। বিচার পাচ্ছে না। সেটা আর এখন আলোচ্য বিষয় নয়। কারণ কাকিসটোক্র্যাসি কায়েম হয়ে গেছে, যেখানে ‘অযোগ্য-দুর্নীতিবাজ-অপরাধীরা’ পুলিশি রাষ্ট্র কায়েম করে নিজের ক্ষমতা ও স্বার্থ রক্ষা করছে। অন্য কথায়, এখন কাকিসটোক্র্যাসির রাজত্ব।
তাই জন বার্নহিলের মন্তব্য স্মরণ না করে পারা যায় না। যখন জনগণকে ভয় করতে হয় সরকারকে তখন বুঝতে হবে প্রজাপীড়নের শাসন তথা টাইরেনি কায়েম হয়েছে। সরকার জনগণের তোয়াক্কা করলে, জনগণ মুক্তি ও স্বাধীনতা ভোগ করত। বিখ্যাত Born under a bad sky-এর লেখক জেফরি সেন্ট কেয়ার আধুনিককালের সরকারও মুসলমানদের সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণের কৌশলী পদ্ধতিগুলো বর্ণনা করে জন লিলবার্নকে স্মরণ করেছেন। ১৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে চার্লস-১ এর এবং চার্চের অনধিকার চর্চার বিরুদ্ধে এক লেখার কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তবে ওলিভার ক্রমওয়েল এবং পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রতিবাদে তাকে মুক্ত করা হয়। লিলবার্ন সারাজীবন বক্তব্যের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। এমনকি মহাকবি মিলটন তার কর্মে উদ্বুদ্ধ হয়ে বক্তব্যের স্বাধীনতার সপক্ষে বিখ্যাত অ্যারিয়োগেজেটিকা ৪০০ বছর আগে রচনা করেন। লিলবার্ন গোপন বিচার ও পক্ষপাতিত্বের বিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সর্বপ্রথম এটা সর্বগ্রাহ্য করেন যে, রাষ্ট্রের সবাই সমান এবং সবার বলার অধিকার আছে। আদালতকে এ বিষয়টি প্রাধান্য দিতে হবে। সেন্ট জেফরি প্রশ্ন করেছেন সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে, ‘এখন লিলবার্ন (বেঁচে থাকলে) কী করতেন? (Intolerable opinions in an age of secret tribunals)। জেফরি বলেছেন, লিলবার্ন কখনোই হার মানতেন না।
আর সত্য কথাই বলেছেন জর্জ ওয়াশিংটন, ‘সরকার আগুনের মতো, যা চাকর হিসেবে বিপজ্জনক এবং প্রভু হিসেবে ভয়ঙ্কর।’
মজার কথা হলো, রাজনীতিবিদেরা হলেন সেই দল, যারা সমস্যা সৃষ্টি করেন, তার প্রতিবিধানের জন্য জনগণের কাছে যান এর সমাধানের জন্য। সমাধান? তাদের ক্ষমতায় বসাতে হবে। রাজনীতির এটা একটি অমোঘ বিধান যেÑ সঙ্ঘাত, মিথ্যা ও অনাচার ছাড়া রাষ্ট্রাচার প্রায় অসম্ভব। আর এই মিথ্যা-সঙ্ঘাত-দুর্নীতিকে প্রতিহত করার সংগ্রামও চলমান।

শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

অনৈতিকতা, অবৰয় ও ফ্যাসিজম



২০১২-০৩-২৪

সমপ্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা, মানবাধিকার, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডসহ সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের ওপর নানা প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে। হিউম্যান রাইটস, অধিকার, এমআরটি ও পুলিশ সূত্র অনুসরণ করে প্রতিবেদনগুলোতে ফেব্রম্নয়ারি মাস পর্যনৱ গত ৪৯ মাসে ঘটিত হত্যাকাণ্ড, আত্মহত্যা, ধর্ষণ, রাজনৈতিক সংঘর্ষ, সীমানৱ সন্ত্রাস, সড়ক দুর্ঘটনা, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা এক কথায় ভয়াবহ। দেখা গেছে, একসময়ে এক অপরাধ বাড়ছে আর অন্য একসময়ে অন্য অপরাধের আধিক্য নজরে পড়ছে। তবে অপরাধের নিম্নগতি কোথাও নেই। আর অপরাধী চক্র ক্রমান্বয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। 
সংবাদপত্রগুলো অবশ্য মাসিক হিসাবও দিচ্ছে। উলেস্নখযোগ্য বিষয় হলো, এ সংবাদগুলো যেন সবার ‘গা-সওয়া’ হয়ে গেছে। যেমনটি স্বাধীনতা-পরবর্তী বছরগুলোতে হয়েছিল। যেন মানুষকে এমন যন্ত্রণা সইতেই হবে। সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব বোধগম্য। কারণ এসব অপরাধের প্রধান লৰ্য তারাই, যারা কখনো তাদের বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে, কখনো বা অপরাধী হিসেবে বা তাদের দোসর হিসেবে অপবাদ দিয়ে বা অভিযোগ এনে তাদের এই অপরাধের লৰ্য হিসেবে স্থির করা হচ্ছে। সবার কাছে অবাক হওয়ার বিষয় হলো- অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপৰ রম্নটিনের মতো সাফাই গেয়ে যাচ্ছে। এমনকি এরা শানিৱশৃঙ্খলার অবস্থা প্রভূত উন্নতি হয়েছে বলে তারস্বরে দাবি করে। কারণ কী? 
এসব অপরাধের একটা আংশিক চিত্র তুলে ধরে আলোচনায় যাওয়া যেতে পারে। এ চিত্র ওপরের প্রশ্নের একটি জবাবও আংশিক দেবে। 
এক সংবাদ অনুসারে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১১-এর নভেম্বর পর্যনৱ খুনসহ ডাকাতি, চুরি, অপহরণ, শিশু নির্যাতন, নারী নির্যাতন, মাদক কেনাবেচাসহ পাঁচ লাখের বেশি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এর মাঝে ২০০৯ সালে এক লাখ ৫৭ হাজার ১০৮টি; ২০১০ সালে দুই লাখ ৪৩ হাজার ৫৩৪টি এবং ২০১১ সালের নভেম্বর মাস পর্যনৱ এ সংখ্যা এক লাখ ৩৭ হাজার। এ সময়ে সংবাদপত্রের ওপর হামলা-মামলা-খুনের সংখ্যা অতীতের রেকর্ড মস্নান করে দিয়েছে। এদের হিসাব অনুসারে এ সময়ে ছয়জন সাংবাদিক নিহত, ২৮০ জন সাংবাদিক বিভিন্ন হামলায় আহত হন, লাঞ্ছিত হন ১১২ জন, হুমকির মুখোমুখি হন ৯৫ জন, মামলা হয় তিন ডজনের বেশি। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, সামান্য ঘটনার প্রতিবেদনের ওপর মানহানি মামলাসহ নানা ধরনের মামলার সংখ্যা বিশেষভাবে বেড়ে গেছে। অন্য একটি লৰণীয় বিষয় হলো, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের নামে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে অথবা করার চেষ্টা চলছে। এসব ৰেত্রে আইনগত আশ্রয়ের আইনও সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে অস্থিরতা, অসহায়ত্ব ব্যাপকতা লাভ করছে। তবে নিবর্তনমূলক ব্যবস্থার জন্য তার প্রকাশ ঘটছে কম। 
সবচেয়ে ভয়াবহ যে চিত্র এ প্রতিবেদনগুলো দিয়েছে তা হলো- খুন, রাজনৈতিক সহিংসতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বেওয়ারিশ লাশের ছড়াছড়ি। আর গুপ্তহত্যার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ২০১১ নভেম্বর পর্যনৱ খুন হয়েছেন ১২০০ ব্যক্তি। এ ছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৫৯২ জন এবং আহত হয়েছেন ৪০ হাজার ১৯০ জন। এসব নিহতের মাঝে আছেন কলেজশিৰক, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দ। নাটোর ও বড়াইগ্রামে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। 
এ সময় ইভটিজিংয়েই আত্মহত্যা করেছেন ১৫০ জন এবং এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে আটজন অভিভাবক খুন হয়েছেন। শুধু ঢাকা শহর থেকেই উদ্ধার হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৭৬টি বেওয়ারিশ লাশ এবং সাদা পোশাকধারীদের হাতে আটক ১০০-এরও বেশি মানুষের কোনো খোঁজ মেলেনি। 
গত ফেব্রম্নয়ারি মাসে গুপ্তহত্যার ঘটনা ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। ৯০ লাশের বর্ণনাগুলো ভয়াবহ। এর পরে রয়েছে আরো ভয়াবহ রিপোর্ট। ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যনৱ সীমানেৱ এক হাজার ১২ জনকে বিএসএফ হত্যা করে। আহত ও অপহরণ করে বহু নিরীহ বাংলাদেশীকে। গত তিন বছরের সবচেয়ে ভালো সম্পর্কের সময়েও ২৩১ জনকে বিএসএফ হত্যা করে। তবে স্মরণযোগ্য বিষয় হলো- ভারতের অন্য পাঁচটি দেশের সাথে তার সীমানৱ থাকলেও, সেসব সীমানেৱ বিশেষ করে তাদের সবচেয়ে বৈরী প্রতিবেশী পাকিসৱানের সীমানেৱ কোনো বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি গত ১০ বছরে। এক প্রতিবেদনে পাকিসৱানি দূতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, সে দেশের জন্মের পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যনৱ তাদের দেশের কোনো সীমানেৱই ভারতীয় বিএসএফ এমন হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সাহস পায়নি।
প্রশ্ন উঠতেই পারে কেন এমনটি হচ্ছে বারবার। দীর্ঘ আলোচনা না করে, হয়তো বা তিনটি শব্দ দিয়ে এর কারণ বর্ণনা করা যায়। তা হোলো- অনৈতিকতা, অবৰয় ও ফ্যাসিজম। প্রথমে অনৈতিকতা- তার রাজত্ব পুরোপুরি কায়েম করলে জন্ম হয় অবৰয় এবং পরে ফ্যাসিজমের। আর এসবের মূলে ৰমতা ও সম্পদাহরণ। বলাই বাহুল্য, সাধারণ মানুষ নিজের যন্ত্রণাকে কখনো আহ্বান করে আনে না। তাদের ওপর এটা চাপিয়ে দেয়া হয়। যেমন এখন বিশ্বব্যাপী ‘দারিদ্র্য’ নিয়ে চলছে ব্যবসায়। এবং সে ব্যবসায়ে সবাই ব্যসৱ। সুশীলসমাজ, করপোরেট ব্যবসায়ী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। দারিদ্র্য বিমোচনের নামে দরিদ্র সাধারণ মানুষদের আরো শোষণ করছে, দরিদ্র দেশগুলোকে আরো নির্ভরশীল করে তুলছে। এখানে ৰমতাবান আর সম্পদলোভীদের এক কৌশলগত খেলা চলছে।
যেমন বাংলাদেশে এখন গরিব মানুষদের মাঝে শিৰাবিসৱারের নামে নানা অনানুষ্ঠানিক পাঠ্যদানের ব্যবস্থা ও অর্থ বিতরণের কর্মকাণ্ড চলছে। আর সংশিস্নষ্ট সংস্থা ও সরকার প্রতিদিনই এর সাফল্যের গীত গাইছে। কিন্তু বাসৱবতা হলো, শিৰা- যা সত্যিকারের বিসৱার লাভ করছে- তা সেই আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমের মাঝ দিয়েই। আর এখানে শুরম্ন হয়েছে ব্যবসায়ের প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা। এর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা নেই। কারণ ৰমতাবানেরাই প্রধানত এ অসম ব্যবস্থার সাথে জড়িত। তবে কখনো কিছু ব্যবস্থা কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরম্নদ্ধে নিতে দেখা যায়। এগুলোর বেশির ভাগই সে প্রতিষ্ঠান দখল করার জন্য। আর এসব প্রতিষ্ঠান সাধারণত বিরোধী অংশের।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে সব পাওয়ার মাঝে কয়েকটি অত্যনৱ অনাকাঙিত অর্জনও ছিল। তা হলো- ৰমতাসীন ও তাদের সহযোগীদের নৈতিকতার প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা, ৰমতার প্রতি প্রবল আকর্ষণ, বিরোধী দমনে সীমাহীন অসংযত কর্মকাণ্ড, দুর্নীতিতে আনন্দিত আহ্বান। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বললেন, ‘চাটার দল, সব খেয়ে যাচ্ছে।’ মজার কথা, এই চাটার দলের সবাই ছিল তার দলের লোক- যাদের বিরম্নদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু বক্তব্য দিয়ে যন্ত্রণাকিষ্ট সাধারণ মানুষকে বিভ্রানৱ ও শানৱ রাখতে চাইলেন। সেই যে অনৈতিকতাপ্রসূত অনাচারের রাজত্ব কায়েম হোলো, তা গত চার দশকে শুধুই ডালপালা মেলেছে। যখনই কেউ এর সমালোচনা করেছেন, তাদের নানাভাবে নিন্দা করা হয়েছে। এটা তারা করেছেন তাদের অবৈধ সম্পদ ও ৰমতাকে রৰা করতে। এমনকি সমাজের প্রচলিত নৈতিকতাকেও তারা ভয় পান। কেননা মাত্র এই গুণটি তাদের ৰমতার অপব্যবহারকে সীমিত করে ফেলে এবং অবৈধ সম্পদ আহরণের পথে হয় বাধা। স্বাধীনতার পরের তিন বছরের অবস্থা একটু বিশেস্নষণ করলে দেখা যাবে যে, কত দ্রম্নত একটি ধনিক শ্রেণীর উদ্ভব হলো। সে সময়ে ৰমতাবান আর তো কেউ ছিল না। হঠাৎ করেই দেখা গেল সমাজের সম্মানিত ও অবস্থাপন্ন মানুষেরা হারিয়ে যাচ্ছেন আর তাদের স্থান দখল করছেন এই বিশেষ গোষ্ঠী, যারা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে পারঙ্গম।
নৈতিকতাহীন অবস্থা জন্ম দেয় অবৰয় ও ফ্যাসিজমের। এ দু’টি বৈশিষ্ট্য এমনই যে, এর ব্যবহার শুরম্ন হয়, কখনো শেষ হয় না। এর একমাত্র কারণ- ৰমতা। তাই বিখ্যাত মার্কিন রাজনীতিবিদ হেনরি অ্যাডামস ৰমতাকে একধরনের বিষের সাথে তুলনা করেছেন, যা অনৱর্নিহিত নৈতিকতাকে অন্ধ করে দেয় : Power is poison; and it is a poison, which blinds the eyes of moral insight and lames the will of moral purpose. বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দাবিদারেরা কখনোই ভাবতে পারেন না এ দেশের জনগণেরও কোনো অধিকার আছে, কর্তব্য আছে, জনগণ ভাবতে পারে, স্বাধীন বক্তব্য দিতে পারে। যখন এসব ৰমতাবানের স্বার্থ রৰার প্রয়োজন হয়, তখনই তারা জনগণের বিশাল ত্যাগের ফিরিসিৱ দিয়ে, যেকোনো প্রতিবাদীকে ‘বলি’ দেয়ার জন্য তৎপর হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানপ্রণেতা জেমস ম্যাডিসন সম্ভবত এদের কথা ভেবেই স্বৈরতন্ত্র ও স্বেচ্ছাচারের চমৎকার সংজ্ঞা দিয়েছিলেন : The accumulation of all powers, legislative, executive, judiciary, in the same hands... is the definition of tyranny. Ñ James Madison। গত চার দশক ধরেই ঠিক এই কর্মকাণ্ডটি ৰমতাবানেরা, বিশেষ করে স্বাধীনতার নেতৃত্বের দাবিদারেরা, অবিরাম চালু রেখেছেন। সম্ভবত এবারই ম্যাডিসনের বক্তব্যের পূর্ণ বাসৱবায়ন ঘটেছে।
ফলে দেখা যাচ্ছে আইন প্রণয়নকারী, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের কর্মকাণ্ডের মাঝে কোনো পার্থক্য লৰ করা যাচ্ছে না। বিচার বিভাগ যে বক্তব্য দিচ্ছে তা নির্বাহী বা আইন প্রণয়নকারীর মতোই প্রতিভাত হচ্ছে। বিচার ও রাজনীতির মাঝে কোনো পার্থক্য লৰ করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে বিচার বিভাগের রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে সংসদেও আলোচনা হয়েছে। জনগণের শেষ ভরসাস্থলও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এমনটি নতুন বলা যাবে না। ইউরোপে মধ্যযুগে এর ব্যাপক ব্যবহার ছিল। অ্যাডামস বলেছেন- এরপর যখন গণতন্ত্রের উদ্ভব হোলো, এ ৰমতাবানেরা কৌশলে একে নিজের স্বার্থে ব্যবহার শুরম্ন করল : The fact that democratic sentiment could be exploited to create a tyranny more sanguinary and terrible than those which it sought to ostensibly to destroy; that dream of equality, fraternity and liberty turned into nightmare.
অ্যাডামস যেন বাংলাদেশের ২০১২ সালের অবস্থার বিবরণ দিচ্ছেন প্রায় ১০০ বছর আগে। বর্তমানের ৰমতাসীনদের বক্তব্য আর কর্মকাণ্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর এক প্রতিষ্ঠাতার বক্তব্য বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। থমাস জেফারসন বলেছিলেন, ‘স্বৈরাচার শুধু এটুকুই চায় যেন বিবেকবান মানুষ চুপ থাকে’ : All tyranny needs to gain a foothold is for people of good conscience to remain silent. আসলে গণতন্ত্রের উদ্ভবের পরে ৰমতালিপ্সু একদল মানুষ সব প্রথাকেই নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছে। এরই পথ ধরে ফ্যাসিজমের জন্ম ও লালন। এসবের লালিত হওয়ার কারণ একটিই, তা হলো- সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে অন্য কোনো উপায়ে এত সহজে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণে যা-ই নির্মাণ করছে- এই ৰমতালিপ্সুর দল তা কুৰিগত করে তাদের স্বার্থের কাজে লাগাচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বে এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে গণতন্ত্রের অঙ্গনে। তাই তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি এত উত্তপ্ত এবং জনগণ যন্ত্রণাকিষ্ট। 
একটু নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য ফ্যাসিবাদের দশটি পথের কথা এখানে উলেস্নখ করা যেতে পারে। নাওমি উলফের দেয়া হিটলার-মুসোলিনী-স্টালিনের পথগুলো হলো :
০১. Invoke a terryfying internal and external enemy : বাইরের ও ভেতরে শত্রম্নর কথা উলেস্নখ করে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করতে হবে যেকোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে; প্রতিদিন মিটিং-মিছিল করে এসব শত্রম্নদের বিরম্নদ্ধে জনগণকে শঙ্কায় ফেলতে হবে।
০২. Create a gulag : একবার সবাইকে ভয়ের মাঝে নীত করে সেই ‘গুলাগের’ সৃষ্টি করতে হবে যেখানে আইনের বাইরে হাজার হাজার মানুষকে অনৱরীণ রাখা হবে; 
০৩. Develop a thug caste : এটা করার সাথে সাথে দলের একাংশ, বিশেষ করে যুব শ্রেণীকে নানা ধ্বংসাত্মক ও হত্যাকাণ্ডে নিয়োজিত করতে হবে- যেমন যুব, ছাত্র, কর্মী, শ্রমিক নামধারী সংগঠন- যা ইংরেজিতে বলে Thug caste- এদের অন্যায়কে সরকার সমর্থন করবে; ফলে সব সরকারি অন্যায়কে ‘গা-সওয়া’ মনে হবে এবং জনগণ প্রতিবাদের সাহস পাবে না। 
০৪. Setup a surveillance system : অভ্যনৱরীণ কড়া নজরদারিব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হবে যাতে কোনো প্রতিবাদ বা সমালোচনা না হয়; এটা জাতীয় সংহতি ও নিরাপত্তার জন্য করা হচ্ছে বলে তারস্বরে প্রচার করতে হবে- তবে এর প্রধান কাজ হবে প্রতিপৰকে তীব্র হয়রানির মাঝে রাখা;
০৫. Harass citizens group : প্রতিটি দল চিহ্নিত করে তাদের নানা দুর্নামে ভূষিত করে, গোয়েন্দা ও দলীয় নানা বাহিনী দিয়ে অবিরাম হয়রানি করা; 
০৬. Arbitrary detention of noted person : উলেস্নখযোগ্য ব্যক্তিদের যথেচ্ছ গ্রেফতার। যা নিয়ে এখন খবরের কাগজে প্রায়ই গ্রেফতার বাণিজ্যের কথা আসছে;
০৭. Target key persons : সমাজের বিভিন্ন মুখ্য ব্যক্তিদের লৰ্যে পরিণত করে তাদের ওপর নজর রাখা। এদের বিশ্বসৱ না মনে হলে এদের চাকরিচ্যুত, ব্যবসায় ৰতিকর বা অন্য যেকোনো উপায়ে এদের নিসৱব্ধ করে ফেলা;
০৮. Control the press : সবচেয়ে বড় কাজ সংবাদমাধ্যমকে সমপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা। বারবার বন্ধ করে দিতে হবে অথবা হামলা-মামলা দিয়ে ভীত রাখতে হবে;
০৯. Dissent means treason : প্রতিবাদ অর্থ রাষ্ট্রদ্রোহ। কোনো আলোচনা, তথ্য বা বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহ বলে অভিহিত করে তীব্র আন্দোলন করে, বশংবদের দ্বারা বিচারব্যবস্থায় নেয়া; এবং
১০. Suspend rule of law : আইনের শাসনের কথা জনগণকে ভুলতে বাধ্য করা হবে।
এখন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত এই ১০ অবস্থার মাঝ দিয়ে বাঁচতে হচ্ছে। হিটলার আরো বলেছিলেন, ৰমতাবানদের মিথ্যে বলতে হবে, তবে সবচেয়ে বড় মিথ্যা। কারণ জনগণ ভাবতেই পারে না সরকার এত বড় মিথ্যা বলতে পারে। তারপর সেই মিথ্যা বারবার বলবে, তখন আর জনগণকে নিয়ে ভাবতে হবে না। হিটলার তার ৰমতা চিরস্থায়ী 
করার জন্য এ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। সে চিত্র এখন 
এত প্রকট। 

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

ফ্যাসিবাদের দশ পথ

অ্যাগেইনস্ট এম্প্যায়ার গ্রনে'র লেখক মাইকেল প্যারেন্টি লিখেছেন, ‘এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার কিছু দেশকে তৃতীয় বিশ্ব বলে আমাদের ডাকতে বলা হয় কারণ তারা দরিদ্র।’ তিনি বলেছেন, এ বক্তব্যের পেছনের যুক্তি হলো এসব দেশের জমি অনুর্বর আর মানুষেরা মূল্যহীন। এটা ঐতিহাসিক ঘটনা। প্যারেন্টি বলেন, এটা সত্য নয়। কারণ, তা যদি হতো, তবে ইউরোপিয়ানরা সব কষ্ট সহ্য করে এসব তৃতীয় বিশ্ব দখল করতে গেল কেন? এ জন্য যে, এ তৃতীয় বিশ্ব তাদের চেয়ে ধনী ছিল। তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ সম্পদ ও খাদ্যসম্ভার তাদের প্রলুব্ধ করেছিল। গরিব দেশে গিয়ে কেউ নিজকে ধনী বানাতে পারে না, প্যারেন্টি লিখেছেন। সেই যে সম্পদ লুণ্ঠন শুরু হলো, তা আজো শেষ হয়নি। আর এই লুণ্ঠনপ্রক্রিয়াতে ব্যবহার করছে তাদের নিজেদের তৈরি নিয়ম, নীতি, পদ্ধতি। এরই পথ ধরে এসেছে সাম্রাজ্যবাদ এবং তা টিকিয়ে রাখতে সৃষ্টি হয়েছে ফ্যাসিবাদ। আর ফ্যাসিবাদকে ব্যবহার করা হচ্ছে গণতন্ত্রের আড়ালে, স্বৈরশাসক সৃষ্টির মাধ্যমে। এর মাঝে তথাকথিত গণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকের সংখ্যাই বেশি। প্যারেন্টির মতে, এই ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকেরা’ বেশি চাকরগিরিতে সক্ষম। কেননা দুর্নীতিবাজ চাকরদের মতো তারা অবৈধ কর্মকাণ্ডের ভাগ পান। এগুলো ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সম্পদের লুণ্ঠন।
যে কারণে এখন এটা সার্বজনীন সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ যত দুরূহ এবং পথ যেমন দীর্ঘ, তেমনি তা নস্যাৎ করা তত সহজ এবং সময় হলো সংক্ষিপ্ততম। আর এটাও এখন ঐতিহাসিক সত্য, গণতন্ত্রের বিসর্জন হয়ে থাকে গণতান্ত্রিক পথেই। গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারেরা এ কাজটি করে থাকে ফ্যাসিবাদের হাত ধরে। এ নিবন্ধে এই স্বৈরাচারেরা গণতান্ত্রিক লেবাসে মুসোলিনির দশটি পথ কেমনভাবে ব্যবহার করে তার একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যায়। এ সবই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টায়- আবার গণতান্ত্রিক লেবাসে। আসলে সমস্যাটা সৃষ্টি করেছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ। তারা রাজতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণে আনতে আট শ’ বছর নানা খড়কাঠি পুড়িয়ে গণতান্ত্রিক ধারার সৃষ্টি করেছিল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, যেখানে ক্ষমতা থাকবে জনগণের হাতে এবং একে গণতন্ত্র বলা হবে। প্রমাদ গুনল ক্ষমতাপ্রয়াসীরা। তারা গণতন্ত্রের ধারায় ক্ষমতা ভোগের পক্ষপাতী ছিল না। তাই তারাই সৃষ্টি করতে থাকল নতুন নতুন উপসর্গ, যার মাধ্যমে জনগণ তাদের অধিকার একটু একটু করে ছাড়তে থাকল এবং তা কখনো যে ছিল বা এখনো তাদের অধিকার আছে তা-ও ভুলতে শুরু করল।
এবারের ওয়াল স্ট্রিট দখলের মহড়ার মাঝ দিয়ে একটি জিনিস প্রকাশ পেয়েছে। তা হলো, এখন পশ্চিমা জনগণ তাদের অধিকারের কথাও সঙ্ঘবদ্ধভাবে বলতে পারছে না। তাহলে পশ্চিমাদের তৈরি তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের অবস'া, বিশেষ করে যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই বা তার বদলি কর্মকাণ্ড চলছে এবং গণতান্ত্রিক অ্যাজেন্ট দিয়ে শাসন চলছে, তার চিত্র কত ভয়াবহ হতে পারে তার মাত্র একাংশ নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমেও প্রচারিত হচ্ছে। ওয়াল স্ট্রিটের প্রতিবাদকারীরা বলতে চাইছেন, মার্কিন মুলুকের একাংশ যেসব সম্পদের অধিকাংশ ভোগ করছে তার অংশ অপর ৯৯ শতাংশের সাথে ভাগ করে ভোগ করতে হবে। কিন' এ কথা তাদের স্পষ্ট করে বলতে দেয়া হচ্ছে না। হাফিংটন পোস্টে প্রকাশিত এ নিবন্ধে বলা হয়েছে প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো খবরগুলো সঠিক প্রচার করছে না। বিখ্যাত বিশ্লেষক রবার্ট শিয়ার বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান আর্থিক সঙ্কটের যে প্রতিবাদ হওয়া উচিত তার কণাকানিও এই ওয়াল স্ট্রিটের প্রতিবাদকারীরা করেননি। তিনি কংগ্রেসনাল বাজেট অফিসের রিপোর্ট উল্লেখ করে বলেন, এই এক শতাংশ ধনীদের আয় ১৯৭৯-২০০৭ মধ্যে ২৮০ শতাংশ বেড়েছে অথচ অপরাংশের আয় কমে গেছে। শিয়ার বলেন, এই প্রতিবাদকারীদের বক্তব্য প্রথম তুলে ধরেন বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিটস। তার ‘অব দি ১% বাই দি ১% ফরদি ১%’ নিবন্ধে একটি কড়া মন্তব্য করেছেন। মার্কিনিরা অন্য দেশের নির্যাতনকারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গভীরভাবে অবলোকন করার সুযোগ পায়। এসব সরকার মাত্র কিছু মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত করার সুযোগ দেয়। অথচ তাদের দেশের মাত্র ১% মানুষ যে ৪০% সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে তার খবর রাখে না। যারাই সামান্য কিছু বক্তব্যও দিচ্ছে তাদের কারারুদ্ধ করা হচ্ছে। এমনিভাবে কারারুদ্ধ হলেন বিখ্যাত লেখিকা, নারী আন্দোলনকারী নাওমি উলফ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নিষিদ্ধ যায়গায় দাঁড়িয়েছিলেন। উলফ ম্যানহাটানে স্কাইলাইট স্টুডিওর সামনে ফুটপাথে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি ‘গেম চেঞ্জার অব দি ইয়ার’ পুরস্কার অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। নিউইয়র্ক স্টেটগভর্ণর অ্যামড্রিড কুন্ডমোকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। এ অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন হাফিংটন পোস্ট পত্রিকা, যেখানে উলফ নিয়মিত লেখক। এ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বিখ্যাত ব্যক্তিরা। যারা স্কাইলাইট স্টুডিওর সামনে জড়ো হয়েছিলেন, তারা গভর্নর কুয়োমোর ট্যাক্স প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে এসেছিলেন। পুলিশ তাই ফুটপাথ খালি রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। সব চলাচল বন্ধ করে। তবে নাওমি উলফকে আটক করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নেয়ার ঘটনাটি প্রতিবাদকারীদের জন্য শাপে বর হলো। সারা বিশ্বের প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো ওয়াল স্ট্রিট দখলের খবরে আগ্রহান্বিত হলো আর প্রথমবারের মতো সরকারি প্রচারের অসত্য তথ্যের আলোচনার সূত্রপাত হলো।
আসলে নাওমি উলফ সাধারণ মানুষের জন্য লিখছেন, বিক্ষোভ মিছিল, বক্তৃতায় অংশগ্রহণ করছেন। তার একটি বিখ্যাত বক্তৃতা ছিল ফ্যাসিবাদের ওপর। তিনি দেখিয়েছেন কেমন করে ফ্যাসিবাদ ধীরে ধীরে গণতন্ত্রকে গ্রাস করে নিয়েছে। আর এখন এই গণতন্ত্রের লেবাস পরে ফ্যাসিবাদের মন্ত্র ও কর্মকাণ্ড চালিয়ে ক্ষমতাসীনদের সব অপকর্ম ও জনবিরোধিতার হাতিয়ার হয়ে গেছে। প্রায় চার বছর আগে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যেন হলে ‘ফ্যাসিবাদের পথে’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় চমৎকারভাবে আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীনেরা কেমনভাবে স্বৈরশাসক হচ্ছেন, একনায়কত্বের পথ অনুসরণ করছেন এবং ক্ষমতাসীন দলকে সে পথে চলতে বাধ্য করছেন তার বিশদ বর্ণনা দেন। তারা সর্বদা গণতন্ত্রের কথা বলছেন। প্রচণ্ড প্রচার চালাচ্ছেন কেমনভাবে তাদের পূর্বসূরিরা তা হরণ করেছিলেন এবং কেমনভাবে তাদের বর্তমান প্রতিপক্ষ ও প্রতিবাদকারীরা গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সংবিধানকে একটি গোপন দলিলে পরিণত করেছেন যেন জনগণ তাদের অধিকার সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর না রাখে অথবা এমন ভীতিকর অবস'ার সৃষ্টি করা হয় যাতে তারা তেমন কোনো খোঁজও না নিতে পারে, এমনকি ইচ্ছেও করে। তারা একদল অধ্যাপক, আইনজ্ঞদের কাছে এ বিষয়টি তুলে দিয়ে দাবি করেন, এটা অন্য কোনো বিশেষজ্ঞ বা অনুসন্ধানকারীদের বিষয় নয়। আর সংবিধানের নানা পরিবর্তন করেন কখনো বশংবদ পার্লামেন্টকে দিয়ে, কখনো বা বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে প্রশাসন-ক্ষমতাকে নিবৃত্ত রাখার সব বাধানিষেধ (চেক অ্যান্ড ব্যালান্স) ভেঙে ফেলা হয়। সে কথা সাধারণ নাগরিক অনুভবও করতে পারে না।
(১) এ পদ্ধতিগুলোর প্রথম পদক্ষেপ হলো ভেতর ও বাইরের ভয়াবহ শত্রুর উপসি'তির ঘোষণা করে প্রয়োজনীয় আইন পাস করো, যা দিয়ে উদ্দেশ্য সাধনে বাধা হতে পারে এমন ব্যক্তি ও শক্তিকে রাষ্ট্রীয় শক্তি দিয়ে দমন বা নির্মূল করো। তিনি মার্কিনিদের প্যাট্রিয়টিক অ্যাক্টের বিষয় তুলে ধরে বলেন, এই আইনটি পাসের সময় কংগ্রেসে প্রায় কোনো আলোচনাই হয়নি। মার্কিনিদের এমন ভীতির মধ্যে ঠেলে দেয়া হয় যে তারা তাদের সব ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও অধিকার ছেড়ে দিতে প্রস'ত হয়। অথচ গত তিন শতাব্দীতে কখনো সে দেশ কোনো বৈদেশিক আক্রমণের সম্মুখীন হয়নি। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অন্তত পাঁচ ডজন দেশ আক্রমণ করেছে, এবং তাতে লাখ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটেছে। তিনি বলেছেন, নাজিরা কমিউনিস্টদের ভয় দেখায়, এখন ‘ইসলামি সন্ত্রাসী’ ভয় সমগ্র বিশ্বব্যাপী। এ ব্যাপারে উইলিয়াম ব্লাস তার রোগ স্টেট বইতে বলেছেন, এমনকি আমাদের শত্রুরাও আমাদের মিথ্যা কথায় বিশ্বাস করে।
শুধু মার্কিন মুলুকে নয়, সারা বিশ্বেই এ জুজুর ভয় দেখিয়ে, কখনো বা গোপনে ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়ে সাধারণ মানুষকে ভীতির মাঝে রেখে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকছে এসব ক্ষমতালোভী। তারা সবার অধিকার এভাবে কেড়ে নিচ্ছে। এমনকি বিচার, বিচারক সবাই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিকারীদের এই মিথ্যার সাথে সহযোগিতা করছেন অথবা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
(২) এর পরের পদক্ষেপ হচ্ছে রাশিয়ার কুখ্যাত গুলাগ সৃষ্টি। রাশিয়ার কমিউনিস্টরা ১৯৩৩ সালে এর ব্যাপক প্রচলন করে। সমগ্র দেশটিই যেন একটি কারাগার। পুলিশ, বিচারালয় ও সরকারি দলের কর্মীরা নিজেরাই অভিযোগকারী, বিচারক ও শাস্তিদাতা হয়েছিল। নাজিরা এ ব্যাপারে আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। যদি কেউ, এমনকি সংবাদকর্মী কারো ব্যাপারে কিছু লিখল এমন হতো সে-ই ট্রাইব্যুনালের প্রধান হয়ে গেল। জার্মানিতে সে সময় এত ট্রাইব্যুনাল ছিল যে সাধারণ মানুষ ভয়ে মুখ খুলত না। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ২৪ এপ্রিল ১৯৩৪। নাজিরা ‘জনতার আদালতের’ সূত্রপাত করল। এগুলো কোনো আইন দ্বারা পরিচালিত হতো না। তারা ইচ্ছেমতো প্রতিপক্ষ বা যে কাউকে ধরে মাসের পর মাস আটকে রাখত, অত্যাচার করত। এমনকি বন্দীরা মৃত্যুবরণ করতেন। যারা নাজি পদ্ধতি, নীতি বা তাদের কর্মকাণ্ডের সামান্যতম সমালোচনা করতেন, তাদের ওপর নেমে আসত চরম বিপর্যয়। এ অবস'া এখন বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে। এখন এসব গুলাগ যেমন গুয়ানতানামো বে সম্পর্কে এমন প্রচারণা চালানো হয় যেন মানুষ ভাবতে শুরু করে এখানে এ দেশের মানুষ থাকে না। একপর্যায়ে এখানের বাসিন্দা হয় সুশীলসমাজের সদস্য, বিরোধী দলের সদস্য, লেবার, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ সবাই। ইতালি, জার্মানি, ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়ার দেশগুলোতে তাদের অবসি'তি উল্লেখযোগ্য।
(৩) এর পরের পদক্ষেপ আরো ভয়াবহ। এরা হলো পেটোয়া বাহিনী। সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতায় যুবকদের এই বাহিনীতে জড়ো করা হয়। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখল করে, তাদের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অঙ্গেও ঢোকানো হয়, যেমন- পুলিশ, গোপন দল ইত্যাদি। আবার এদের নিয়ে কিছু প্যারামিলিটারি দলও তৈরি করা হয়। এরা সাধারণত আইনের ঊর্ধ্বে থাকে। নাওমি বলছেন, এসব দল গণতন্ত্রে সবচেয়ে প্রয়োজন, যেন জনগণ কোনো মতামত যৌথভাবে নিতে না পারে; বিশেষ করে যদি তা সরকারবিরোধী হয়। এমনকি এদের ছত্রছায়ায় ভাড়াটে সৈন্যরাও কাজ করে।
(৫) মুসোলিনির ইতালি, হিটলারের জার্মানি এবং কমিউনিস্টদের দেশের খবরদারি পদ্ধতিটি ফ্যাসিবাদীর প্রধান স্তম্ভ। এই গোয়েন্দাগিরি এখন সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষের সব ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে এটা খানিকটা অমার্জিত। তবে উন্নত বিশ্বে প্রযুক্তির সাহায্যে এর ব্যবহার ব্যাপক। সরকার সব রকম দল, গোষ্ঠীতে অনুপ্রবেশ করে তাদের কর্মকাণ্ডকেও কখনো কখনো প্রভাবিত করে থাকে। এর সপক্ষে নানা আইনও পাস করা হয়েছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন পশু অধিকারের জন্য কোনো প্রতিবাদ হলে এটাকে সন্ত্রাস বলে আখ্যায়িত হয়। নাওমি বলেছেন, সন্ত্রাসের সংজ্ঞার এখন কোনো সীমারেখা নেই।
(৬) ফ্যাসিবাদীর ষষ্ঠ পদক্ষেপ একইভাবে মারাত্মক। এ নীতিতে ‘যাকে ইচ্ছে ধরো এবং যাকে ইচ্ছে ছাড়ো’ পদ্ধতির দলে প্রয়োজনীয় ভীতির রাজ্য কায়েম করা যায়। যেমন সরকার ঠিক করবে কোন ব্যক্তিকে হেনস্তা করা হবে। তাকে আটক করে নানা অপবাদে অপদস' করা হলো এবং বশংবদ সংবাদমাধ্যম তা যত্নসহকারে প্রচার করতে থাকে। বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা এখন আর কোনো ঘটনা নয়। যেমন একবার অ্যাডওয়ার্ড কেনেডিকে, প্রফেসর ওয়াল্টার মারফিকে প্লেনে উঠতে দেয়া হয়নি, কারণ সন্ত্রাসী লিস্টে তাদের নাম ছিল। তেমনিভাবে ফ্যাসিবাদী কোনো সরকার ক্ষমতায় গেলে তাদের পন'ী সব অপরাধীকে ছেড়ে দেয়, এমনকি ফাঁসির আসামিকে। অথচ তার চেয়ে কম অপরাধী বা নিরপরাধ সমালোচকেরা ছাড়া পায় না। যেকোনো সরকার এমন ব্যবহার করলে বুঝতে হবে তারা প্রকৃতই ফ্যাসিবাদী। তবে তারা যে লিস্ট তৈরি করে, তা কখনো পুরনো হতে দেয় না।
(৭) ফ্যাসিবাদীর আর একটি পদক্ষেপ হলো বিরোধী, সমালোচক, অধিকারের দাবি এবং নিরপেক্ষ জননন্দিত মানুষদের লক্ষ্যবস' করা। গভীরভাবে তাদের পাহারা দেয়া। এরা ক্ষমতায় গেলে প্রথমেই রাষ্ট্রীয় অঙ্গে অনুগত স'াপনে ব্যস্ত হয়। যথাসম্ভব প্রশাসন, শিক্ষাসহ সব জায়গা থেকে নিরপেক্ষ ও বিরোধী মনোভাবাপন্নদের অনৈতিকভাবে বহিষ্কার করা হয়। যেমন মার্কিন সরকার আটজন আইনজ্ঞকে চাকরিচ্যুত করল, কারণ তাদের রাজনৈতিক আনুগত্য স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বে এই ফ্যাসিবাদী ব্যবস'া ভয়াবহ। হাজার হাজার কর্মচারীকে বিদায় দেয়া হয়।
(৮) ফ্যাসিবাদের অষ্টম পদক্ষেপ হলো সংবাদমাধ্যমকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা। এটা প্রয়োজন এ জন্য যে, জনগণকে অন্ধকারে রেখে তাদের নিজেদের অ্যাজেন্ডা এগিয়ে নেয়া। এখন উন্নত বিশ্ব ও অন্য বিশ্বে প্রায় একই চিত্র। শুধু পার্থক্য হলো ওপরের পালিশ। বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম বন্ধসহ নানা বিধিনিষেধের কথা সবার জানা। ফ্যাসিবাদীরা মিথ্যা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা কতটুকু পানি ঘোলা করা গেল তার ওপর জোর দেয়। আসলে এখন বিশ্বব্যাপী কোথাও নির্ভেজাল সত্য খবর পরিবেশন করা বিপজ্জনক অথবা অসম্ভব হয়ে গেছে। এটা ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
(৯) প্রতিবাদ মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ। ফ্যাসিবাদের এই নীতি এখন সবাই সাদরে গ্রহণ করেছে। নানা আকারে এবং যুক্তি দিয়ে প্রতিবাদকে সন্ত্রাস, রাষ্ট্রদ্রোহ, দেশের শত্রু, জনগণের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। নাওমি উলফ বলছেন, প্রতিবাদকে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং সমালোচনাকে গোয়েন্দাগিরি হিসেবে এর মধ্যেই উপস'াপনা করা হয়েছে। তার কথামতো সাধারণ মানুষের জন্য বিচারের দরজা ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যদিও সবই আছে- সংবাদপত্র, আদালত, টিভি ও রেডিও, এমনকি সুশীলসমাজ। কিন' কোথাও সত্যিকারের প্রতিবাদ নেই, স্বাধীনতা নেই।
(১০) ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় নীতি হলো আইনের শাসনকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা। ক্ষমতাবানেরা ক্রমান্বয়ে তাদের ক্ষমতার বলয় আইনগতভাবে এমন বাড়িয়ে নিয়েছে যে এখন আইনের শাসন বলতে কিছু নেই। সবচেয়ে ভীতিকর বিষয় হলো সারা বিশ্বের মানুষকে প্রায় বাধ্য করা হয়েছে যে অধিকার দুই রকমের। যারা ক্ষমতায় আসীন তাদের জন্য আইন ও অধিকার তাদের প্রয়োজনে। কিন' সাধারণ মানুষের জন্য আইন নিজেই অসহায়। এ আইন পরিচালনা করে সরকারের পেটোয়া বাহিনী, অনুগ্রহীতের দল। এ দল কারা? জর্জ বার্নার্ড শ নাজিদের জন্য একটা চমৎকার সংজ্ঞা দিয়েছিলেন তিনটি শব্দ দিয়ে। সুশীল, বুদ্ধিমান ও নাজি। যদি কেউ সুশীল ও নাজি হয় তাহলে সে বুদ্ধিমান হবে না। কেউ বুদ্ধিমান ও নাজি হলে সে সুশীল হবে না। আর যদি কেউ সুশীল ও বুদ্ধিমান হয়, সে নাজি হতে পারবে না। বার্নার্ড শ-এর এই সংজ্ঞা যদি বাংলাদেশের সরকারি দলের কর্মীসহ তৃতীয় বিশ্বের সরকারি দলের কর্মীদের ব্যাপারে আরোপ করা হয়, তাহলে আজকের শুদ্ধ রাজনৈতিক কর্মীদের এবং ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক কর্মীদের ব্যাপারে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস ম্যাডিসন এক লেখায় বলেছিলেন, যদি সব ক্ষমতা, আইন প্রণয়নকারী, প্রশাসনিক ও বিচারিক যদি একই হাতে (অথবা গোষ্ঠী বা দলে) থাকে, তাকে নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচারের প্রকৃষ্ট সংজ্ঞা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
এখন গণতন্ত্রকামী বলে পরিচিতরা প্রায়ই জনকল্যাণ নয়, আত্মকল্যাণে রত থেকে ফ্যাসিবাদের দশ পদক্ষেপে ব্যস্ত থাকছে। ফলে মানবতা, ন্যায়বিচার বিশাল হুমকির মধ্যে পড়েছে।

অবিচারের বিরুদ্ধে বলার সময়


২০১১-১১-১৫

বিশ্বব্যাপী এখন যে ৯৯ শতাংশের আন্দোলন চলছে, তার ঢেউ এখনো বাংলাদেশে তেমনভাবে আছড়ে পড়েনি। হয়তোবা এ জন্য যে, বাংলাদেশের শোষক শাসক লুটেরাদের অংশ এক থেকেও কম, অথচ তারা এত শক্তিশালী এবং সংগঠিত যে, যারা এদের বিরুদ্ধে তাদের আর্তি জানাবে, তারাও এই অর্ধ শতাংশের (ধরা যাক) হয়ে নিজেদের বিরুদ্ধেই কাজ করছে।
এক শতাংশের আর্তির শুরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটে। এটাকে বিশ্বের আর্থিক রাজধানীও বলা চলে। বিশ্বের এমন কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই, যা এখান থেকে অবলোকন, বিশ্লেষণ এবং পরিচালনা করা হয় না। এমনকি রাজনীতিও। এবং এ সবের একটিই উদ্দেশ্য, তা হলো মুনাফা। এই মুনাফাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বে করপোরেট সংস'া বলে পরিচিত। এদের উত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই, যদিও তখন অন্য নামে পরিচিত ছিল। এ মুনাফার জন্য তারা তখন অগণিত রেড ইন্ডিয়ানকে হত্যা করে, দাস ব্যবসা চালু করে, যুদ্ধ শুরু করে। এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও কেন এদের বিরুদ্ধে বিশাল প্রতিবাদ হয়নি? কারণ তারা অত্যন্ত সজাগ। যারা মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছাতে পারে, তাদের সংগঠিত করতে পারে অথবা কোথাও কেউ কোনো নতুন আবিষ্কার করল, যা তাদের স্বার্থের বাইরে অথবা তার সাথে সংঘাত হতে পারে, তেমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তারা সর্বতোভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই তাদের বিরুদ্ধে শুধু তারাই বক্তব্য দিতে পারছে বা দিচ্ছে, যা বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নেতৃত্বে বা নিয়ন্ত্রণে নেই।
এবার কেন এই ৯৯ শতাংশ বলে পরিচিতদের কেউ কেউ ওয়াল স্ট্রিটের সামনে ধরণা দিল? যাকে তারা বলছে দখল। দিনের পর দিন এদের বিস-ৃতি ঘটছে। এমনকি শিল্পোন্নত দেশের প্রায় প্রত্যেকটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার অধ্যাপক রবার্ট জেনসেন আল জাজিরায় মন্তব্য করেছেন, এই ওয়াল স্ট্রিটের দখলকারীরা এখনো কোনো দাবি তোলেনি। শুধু তারা দেখিয়ে দিয়েছে তাদের যন্ত্রণাগুলো। তবে তিনি বলেছেন, যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তারা তাদের বিত্ত ও বিশেষ সুবিধার আড়ালে নিরাপদে থাকলেও, তারা বুঝতে পেরেছে এই প্রতিবাদকারীরা সঠিক।
উন্নত বিশ্বের সাধারণ মানুষকে এই এক শতাংশরা এ কথা বলে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল যে, তারা (সাধারণ মানুষরা) নিশ্চিত, কারণ রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস'ানের ব্যবস'া করেছে। তারা তা বিশ্বাস করে, তাই এর বিপক্ষে কেউ কিছু বললে তা বিশ্বাস করত না। বিশেষ করে সে বক্তব্যগুলো যেখানে স্পষ্ট করে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে, কেমনভাবে মাত্র এক শতাংশ মানুষ তাদের সম্পদ ও সুখ আনন্দ নিরঙ্কুশভাবে ভোগ করছে। এবারের অর্থনৈতিক সঙ্কটের পরে যখন তারা দেখল তাদের নিরাপত্তা, জীবন ধারণের ব্যবস'া, চাকরি, বাসস'ান, এমনকি খাবারের সংস'ান একেবারেই ভঙ্গুর ও অনিশ্চিত, তখনই এই ওয়াল স্ট্রিটের আন্দোলনকারীদের বক্তব্যে তারা সাড়া দিল। যদিও এখানে তৃতীয় বিশ্বের সেই ভয়াবহ দৃশ্যগুলোর প্রকাশ্য পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না, তবুও ধরপাকড়গুলো, তৃতীয় বিশ্বের মতো পুলিশের অতি বাড়াবাড়িগুলো জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আর ধীরে ধীরে এ আন্দোলন প্রথম বিশ্বে বহু দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
এর কারণ আগেই বলা হয়েছে, তবে তিনজন বিখ্যাত লেখক এবং চিন্তাবিদ এর চমৎকার ঐতিহাসিক বর্ণনা দিয়েছেন। তারা হলেন, এমিরিটাস অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি, অধ্যাপক মাইকেল প্যারেন্টি এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাবেক বৈদেশিক সংবাদদাতা ক্রিস হেজেস। এর মাঝে পুলিশ ক্রিস হেজেসকে এবং আরো ১৬ জনকে গত সপ্তাহে গোল্ডম্যান স্যাকসের সামনে (ওয়াল স্ট্রিটে অবসি'ত) প্রতিবাদ সভা থেকে গ্রেফতার করে। অধ্যাপক ড. করনেল ওয়েস্টের সাথে ক্রিস এখানে যৌথ সভাপতিত্ব করেছিলেন। পরে এক বিবৃতিতে ক্রিস বর্তমানের মার্কিন আর্থিক সঙ্কটের কারণ বর্ণনা করেন। এ সঙ্কট থেকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হয়েছে।
ক্রিস বলেছেন, বর্তমানের বিশ্ব মন্দা ও মূল্যস্ফীতির প্রধান নায়ক গোল্ডম্যান স্যাকস। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গোল্ডম্যানই বর্তমান আর্থিক সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি সরকারি সাহায্য পেয়েছে। এমনকি তাকে ব্যাংক হোল্ডিং কোম্পানি হিসেবে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে যখন গোল্ডম্যান সরকারি সাহায্য পাচ্ছিল, তখন কোম্পানিটি তার টপ এক্সিকিউটিভদের (ওপরের তলার কর্মচারী) ২০০৯-২০১১ সালে মোট ৪৪ বিলিয়ন ডলার বোনাস দেয়। এ তিন বছরে মার্কিন সরকার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তত ১৪ ট্রিলিয়ন (১৪ লাখ কোটি) ডলার সহায়তা দেয়। ক্রিস উল্লেখ করেছেন, (গাল্ডম্যান) বিশ্বের পণ্যমূল্য নির্দেশক (কমোডিটি ইনডেক্স) হিসেবে চাল, গম, চিনি, পশু সম্পদ ও শস্যের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। অর্থাৎ তারা ইচ্ছেমতো মুনাফার খাতিরে খাদ্যশস্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে বিশ্বের কোটি কোটি গরিব মানুষের খাদ্য কেনা তাদের সাধ্যের বাইরে চলে যায়। গোল্ডম্যান প্রতিটি মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী ফান্ডে প্রচুর দান করে। ফলে তারা যে আইন বা সুবিধা চায়, তা পেতে কোনো বেগ পেতে হয় না। যেমন ২০০০ সালে তদানীন্তন সরকার, ‘কমোডিটি ফিউচারস মডারনাইজেশন অ্যাক্ট’ পাস করল, যার ফলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ওপর যে বাধানিষেধ ছিল, তা উঠে গেল। তখন থেকেই বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পণ্যের, বিশেষ করে খাদ্যশস্যের মূল্য দ্রুত বাড়তে থাকল। এক শতাংশের পকেট মুনাফায় ভর্তি হতে থাকল, আর অবশিষ্ট ৯৯ শতাংশের জীবন সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ল। এর ওপর মার্কিন সিনেট সাব কমিটি ৬৫০ পৃষ্ঠার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পেশ করলেও দোষী কাউকে শাস্তি পেতে হয়নি। ক্রিস বলেছেন, এসব কর্মকাণ্ডের ফলে এবং বিভিন্ন সুবিধা পাওয়ার জন্য গোল্ডম্যান স্যাকসসহ সব আর্থিক এবং ব্যাংক প্রতিষ্ঠান অন্তত ৪০ ট্রিলিয়ন (৪০ লাখ কোটি) ডলার মুনাফা করে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে এ পরিমাণ গরিব করে। আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ২০ শতাংশ বেকার (যদি সরকারিভাবে তা ৯ শতাংশ)। এর জন্য পুরোপুরি এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দায়ী।
অবশ্য অধ্যাপক চমস্কি বিষয়টি একটু ঐতিহাসিকভাবে বিশ্লেষণ করে বলেছেন, যে ৯৯ শতাংশ আন্দোলন শুরু হয়েছে তা বিশ্বব্যাপী আরো ব্যাপকভাবে হতে হবে, যদি আমরা সুন্দর ভবিষ্যতের একটি সুযোগ চাই। তিনি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উল্লেখ করেছেন, ১৯৩০ সালের মার্কিন মন্দার সময় সাধারণ মানুষ বিশেষ করে শ্রমিক আন্দোলনের ফলে একটি আশার সৃষ্টি হয়েছিল যে, মন্দার সময় কেটে যাবে। কিন' এবার মানুষের মাঝে এমন হতাশার সৃষ্টি হয়েছে যে, আন্দোলনও জমছে না। এমন অবস'া একেবারেই নতুন।
চমস্কি উল্লেখ করেছেন, বর্তমান অবস'ার সূত্রপাত হয় ৭০-এর দশক থেকে। তার আগে ব্যাংকগুলোর কর্মকাণ্ড ব্যাংকের মতোই ছিল। ৫০-৬০ দশকে বিশাল শিল্পায়ন হয়। সৃষ্টি হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এবং তার সংখ্যা বাড়ছিল। কিন' ৭০ দশকে এসে এর পরিবর্তন ঘটে। শিল্পায়ন বন্ধ হয়ে গেল আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে সব সম্পদ জমা হতে থাকল। এদিকে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির (ইন্টারনেট কম্পিউটার) উন্মেষ ঘটল, সম্পদ সাধারণের কাছ থেকে স্বল্প কিছু মানুষের কাছে জমা হতে থাকে। আর নির্বাচনী ব্যয় বাড়তে থাকে। এই আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং স্বল্পসংখ্যক ধনীরা সে নির্বাচনী ব্যয়ে অংশ নেয়ার ফলে রাজনৈতিক দলগুলো পুরোপুরি এসব প্রতিষ্ঠানের বশংবদ হয়ে গেল। এসব প্রতিষ্ঠান শুধু রাজনীতিই নয়, বিচার ব্যবস'াসহ সব প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পায়। আর শ্রমিক আন্দোলনসহ সব রকমের আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে গেল। এমনকি করারোপসহ সকল প্রকারের সরকারি আর্থিক কর্মকাণ্ডকে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকল। সরকারের বিভিন্ন নিয়োগেও তারা নাক গলাতে থাকল।
চমস্কি বলেছেন, এদের সংখ্যা এক শতাংশ নয়। তার চেয়েও অনেক কম। হয়তোবা এক শতাংশের দশ ভাগের একভাগ। তিনি মন্তব্য করেছেন, মজার কথা এ চিত্র বিশ্বের সব দেশ অনুকরণ করতে থাকে। ফলে প্রতিটি দেশেই এখন দু’টি ভাগ। এক শতাংশ ভাগ্যবান, ক্ষমতাশালী লুটেরা, আর ৯৯ ভাগ অভাগা, নিষ্পেষিত এবং শোষিত। এক শতাংশ এখন এতই শক্তিশালী যে, জনগণের ইচ্ছাকে অনায়াসেই উপেক্ষা করতে পারে। চমস্কি বলেছেন, ঠিক এ অবস'ার কথা অ্যাডাম স্মিথ এবং ডেভিড রিকার্ডো তাদের বইতে উল্লেখ করেছিলেন। চমস্কির আরেকটি ভয়ঙ্কর সতর্কবাণী হলো- এসব করপোরেট যুদ্ধবাজ একপর্যায়ে আণবিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্য তাদের মক্কেল সরকারকে উৎসাহিত করতে পারে। তাতে তাদের মুনাফা। তেমন হলে, তা মানুষের অস্তিত্বকেই অনিশ্চিত করবে। এ ছাড়া আবহাওয়া পরিবর্তনে শিল্পোন্নত দেশগুলো বিশেষভাবে ত্বরান্বিত করছে। অনেক বিজ্ঞানী এরই মাঝে দাবি করেছেন, মানব সভ্যতা ধ্বংস এখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। হয়তোবা কিছুদিন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। এ বক্তব্যের সাথে একমত হয়েছেন অধ্যাপক মাইকেল প্যারেন্টি। মানুষের কথা বলার জন্য তাকে আমেরিকার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি দমে না থেকে গত তিন দশক ধরে লিখছেন আর আন্দোলনে রত রয়েছেন। মাইকেল দাবি করেছেন, আজকের বিশ্বের মানুষে মানুষে বৈষম্যের মূলে রয়েছে মার্কিন নেতৃত্বে বিশ্ব মুক্তবাজার পদ্ধতি। এ পদ্ধতি এখন এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে, কোনো দেশ এর বাইরে থাকলে চাইলে তাকে অচ্ছুৎ করা হয় এবং তার সরকারকে হয় যুদ্ধ নতুবা আর্থিক দিক দিয়ে একঘরে করে সরিয়ে দেয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন মিসরের নিষ্ঠুর একনায়ককে কেমনভাবে যুগের পর যুগ ধরে লালন করা হয়েছে, আর যারা সহযোগিতা করেনি যেমন হুগো শ্যাভেজকে একঘরে করা হয়েছে। প্যারেন্টি এ জন্য খানিকটা মার্কিন জনগণকে দায়ী করেছেন। যদি কোনোমতে তাদের (মার্কিন জনগণকে) বোঝানো যায়, কোনো দেশে রাক্ষস (ডিমন) রয়েছে, তাহলে তারা তাদের সরকারকে সেই দেশের জনগণের ওপর যুদ্ধসহ সব রকমের অত্যাচার, অনাচার, যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে সম্মতি দেবে।
অবশ্য সেই জনতা এখন এই ঘন পর্দার আড়ালে যে এক শতাংশ রয়েছে, তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বলেই ওয়াল স্ট্রিটে প্রতিবাদের মহড়া চলছে। তারা এখন আর পুঁজিবাদকে পবিত্র বলে মনে করছে না। সরকারের সব কর্মকাণ্ডে তাদের যে অটুট বিশ্বাস এবং সমর্থন ছিল, তাতে চিড় ধরেছে। যেমন চমস্কি ভেবেছেন, এ ধারাকে যদি জিইয়ে রাখতে হয়, তাহলে আরো পরিশ্রম করতে হবে, নতুবা শক্তিশালী একাংশ এ প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করতে সক্ষম।
এই চিত্রের বাস্তবতায় বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের অবস'া কেমন? এক কথায় ভয়াবহ। উন্নত দেশের একাংশ শোষকদের আইন ইত্যাদির ছদ্মাবরণে তাদের লুট, শোষণ চালাতে হয়। এমনকি শোষিতরাও তাতে সহায়তা করে। কিন' তৃতীয় বিশ্বের লুটেরাদের এমন ভড়ংয়ের প্রয়োজনীয়তা নেই। তারা নিছক পেশিশক্তি ও ক্ষমতা ব্যবহার করে তাদের লুণ্ঠন ও শোষণ চালিয়ে যায়। ফলে দারিদ্র্যের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ একটি চমৎকার প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন, গত ৪০ বছরের স্বাধীনতা আমলে দরিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৭১ সালে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। চল্লিশ বছর পর এই দরিদ্রের সংখ্যা (ইউএনডিপির ফরমুলা অনুসারে) বেড়ে হয়েছে ১২ কোটি। তাহলে কত পথ পার হলাম, কোন দিকে আমরা যাচ্ছি, তিনি প্রশ্ন করেছেন।
অবশ্যই এই প্রশ্নের জবাব পেতে হবে। কারণ ক্ষমতাসীনরা প্রায়ই আবেগ এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে প্রচার আর আন্দোলনে জনগণকে ব্যস্ত রেখে তাদের স্বার্থ পূরণে ব্যস্ত থাকে। ফলে বাংলাদেশের দরিদ্ররা অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের ভাষায় ‘পশুর দারিদ্র্যসীমার’ (এনিম্যাল পভারটি লাইন) নিচে। অর্থাৎ এ দারিদ্র্যের সমকক্ষ আর কোনো দারিদ্র্য নেই। কারণ শুধু খাবারের অভাবের দরিদ্র ১২ কোটি হলে, সবার শিক্ষা, স্বাস'্য, বাসস'ান, নিরাপত্তাসহ সব অধিকারের হিসাব ধরলে চিত্রটি হবে আরো ভয়াবহ। অথচ এক শতাংশের কম মানুষ সব অধিকার, সম্পদ কুক্ষিগত করে নিয়েছে, আর জনগণের ইচ্ছেকে পদদলিত ও উপেক্ষা করছে।
তাই ওয়াল স্ট্রিটের আন্দোলনকারী এবং সচেতন সংবেদনশীল চিন্তাবিদদের সাথে সুর মিলিয়ে বলতেই হবে- চোর, দস্যু, হত্যাকারীদের প্রতিরোধ করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুবা চমস্কির ভাষায় সুস' সুন্দর জীবন তো নয়ই, এমন অগ্রহণীয় অবস'ায় মানবজাতি পতিত হবে, সেখান থেকে ফেরার পথ থাকবে না। একজন লেখক এর চমৎকার উপমা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই এক শতাংশের কর্মকাণ্ড ক্যান্সার ভাইরাসের মতো, যা আশ্রয়কর্তাকেও পরিশেষে নিধন করে।
অবশ্যই রস কাপুটির মত এ অর্ধাংশে অনুভূতি জাগুক। কাপুটি ইরাকে ফালুজার হত্যাকাণ্ডে মার্কিন বাহিনীর ভেটারান। তিনি বলেছেন, ‘আমি ইরাকের হত্যাকাণ্ড দিয়ে আমার দেশকে সেবা করিনি। আমি এক্সন-মবিল, হ্যালিবারটনের সেবা করে হাজার হাজার ইরাকি এবং একটি শহর (ফালুজা) ধ্বংস করেছি। তাই বলতে চাই যুদ্ধে যাবার জন্য আমরা কোন বীর নই। ...এখনই অবিচারের বিরুদ্ধে বলার সময় এসেছে।’
আসলে এই একাংশরা কত ধনী তার এক সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক নিবন্ধে জর্জ মনবিও। তিনি লিখেছেন, ‘ইতিহাসের সবচে’ ধনী ব্যক্তি কার্লোস স্লিম এখন মেক্সিকোতে বাস করেন। এ হিসাব রোমানদের আমল থেকে এ পর্যন্ত। তার হিসাবের নিক্তি একটু অন্য রকমের। ধনী ব্যক্তিটি কতজনের শ্রমকে কিনতে সক্ষম? তার মতে, স্লিম, ৪৪০,০০০
লোকের শ্রম কিনতে পারেন। সে হিসাবে তিনি কার্নেগির চেয়ে নয় গুণ ধনী এবং রকফেলারের চাইতে চার গুণ বেশি ধনী। তিনি একটু কড়া কথাই বলেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যম, থিঙ্কট্যাঙ্ক ও সরকারগুলোর প্রতি অনুরোধ করেছেন, এই একাংশের ভাঁড়ামি বন্ধ করুন। নতুবা সৃষ্টিকর্তার অমোঘ বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।

অসি'র সমাজ, বিপন্ন মানুষ


২০১১-১২-১৮

স্বাধীনতা সবাই চায় এবং ভালোবাসে। অন্তত এটাই সাধারণ ধারণা। তবে অনেক প্রশ্ন এর সাথে জড়িয়ে থাকে। যেমন স্বাধীনতার অর্থ কী? আমি ক্ষমতাবান বলেই কি আপনার ঘরে প্রবেশ করতে পারব এবং আপনার অর্থ জোর করে কেড়ে নেবো? আপনার বিরুদ্ধে যা ইচ্ছে তা-ই বলতে পারব? যে-কাউকে হত্যা করতে পারব বা অর্থের বিনিময়েই হোক অথবা কারো হুকুমেই হোক?
বর্তমান অবস'াকে একজন পশ্চিমা লেখক চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। তার (ডেভিড ম্যাক গ্রেগরের) মতে, আজকের প্রযুক্তিনির্ভর দুনিয়ায় সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া সমাজে কোনো শক্ত নৈতিকতার ভিত না থাকায়, এসব প্রশ্নের সঠিক ও স্পষ্ট জবাব নেই। অর্থাৎ প্রযুক্তি সর্বপ্রথম নৈতিকতার ভিতকে নড়বড়ে করে দেয় এবং সব বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে প্রথমে যুবা শ্রেণীকে এবং এর সূত্র ধরে পুরো সমাজকে স্বার্থ ও মুনাফা-নির্ভর করে ফেলে। আর এর পথ ধরে আসছে অসি'রতা।
এ অবস'ার উদ্গাতা পশ্চিমা সমাজব্যবস'া হলেও এর প্রচণ্ড ঢেউ এসে পড়েছে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে, যেখানে এই প্রযুক্তি-নির্ভর নৈতিকতাশূন্য আন্দোলন পুরো সমাজব্যবস'াকে অসি'র করে তুলেছে। এই অসি'রতাকে পুঁজি করে ক্ষমতালোভী এবং ক্ষমতাবানেরা হিটলারি কায়দায় প্রচণ্ড প্রচার দিয়ে সাধারণ শান্তি-অন্বেষী মানুষকে বিপন্ন করছে।
এরা দেখেছে পশ্চিমা যৌনতা, অর্থ ও ভোগের বার্তা সমাজের যুবা শ্রেণীকে প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণ করে। এর সম্যক ব্যবহার করে পরিবারব্যবস'াকে ভেঙে এদের ক্ষমতার পথকে নিরঙ্কুশ রাখার প্রচেষ্টায় রত। তবে এরা সবচেয়ে বেশি জোর দেয় সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে অজ্ঞতায় ভরে দেয়ার ব্যাপার। তাই জনগণের কাছে তাদের সমর্থিত তথ্য ছাড়া অন্য কোনো তথ্য যেন পৌঁছতে না পারে, সেই বিশেষ চেষ্টা থাকে। অবশ্য এটি একটি পুরনো ব্যাপার হলেও এর বিকল্প এখনো সৃষ্টি হয়নি। মার্কিনি সংবিধান প্রণেতাদের একজন প্রেসিডেন্ট জেফারসন তার বন্ধু এডওয়ার্ড ক্যারিংটনকে বলেছিলেন, ‘যদি জনগণ তাদের বিষয়ে (পাবলিক অ্যাফেয়ার্স) উদাসীন হয়, তাহলে আমরা, কংগ্রেস ও সংসদ, বিচারক, গভর্নর সবাই নেকড়ে বাঘ হয়ে যাব। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এটাই আমাদের এখন স্বাভাবিক প্রকৃতি হয়ে যাচ্ছে।’ জেফারসনের আরেকজন সহযোগী ড. বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, (জনগণের) অজ্ঞতাই স্বেচ্ছাচারিতা ও জুলুমের সূত্রপাত করে।’ তিনি আরো বলেছিলেন, যে জাতি তথ্যে সুমৃদ্ধ, (ওয়েল ইনফরমড) তাদের দাসত্বে বন্দী করা সম্ভব নয়। যদিও এখন সেই দাসপ্রথা নেই, এর প্রয়োজন সম্ভবত কখনো ফুরাবে না। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র বা মানুষের তৈরি সব শাসনব্যবস'ায় আছে শোষণের কর্মপন'া। আর শোষণ ছাড়াই কেউই দ্রুত বিত্তশালী হতে পারে না। তাই ক্ষমতাবানদের জন্য দাসপ্রথার সুযোগটি প্রয়োজন। অন্য কথায় দাসপ্রথা এখনো আছে, তবে তার প্রকাশ লুকানো। দ্রুত ধনী ও বিত্তবান হতে হলে লুণ্ঠন ও শোষণের বিকল্প নেই। সেই কাজটি এখন স্বার্থপর ক্ষমতাবানেরা কখনো গণতন্ত্রের লেবাস পরে, কখনোবা অন্য তন্ত্র যেমন সমাজতন্ত্রের লেবাস পরে করে থাকে। তাদের অনুগ্রাহী ও হুকুমপালকেরা এক কথায় অতীত দিনের দাস। তবে এসব দাস লুণ্ঠন-শোষণের কিছু ছিটেফোঁটা পেয়ে থাকে। এ কথাই হ্যারল্ড লাসকি বলে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, যে রাষ্ট্রে ধনী-গরিব আছে, সেখানে এমন সরকার গঠিত হবে- যা সাধারণত ধনীদের সুখ-সুবিধা নিশ্চিত করতে ব্যস্ত থাকবে। (A state divided into a small number of rich and a largh number of poor will always develop a government manipulted by the rich protect the amenities represented by their property- Harold Laski) আর এর সাথে যদি গ্যথের বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করা যায়, তাহলে আজকের বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের বহু মানুষের প্রকৃত অবস'ার দৃশ্য পরিলক্ষিত হবে। তিনি বলেছিলেন, ‘তাদের চেয়ে আর কেউই এমন হতাশাব্যঞ্জকভাবে দাসত্বে বন্দী নয়, যেমন- যারা দাস হয়েও ভাবে তারা স্বাধীন ও মুক্ত।’ (None are more hopelessly enslaved than those who falsely believe they are free- Johann Walfgang von Goethe)
এতগুলো উদ্ধৃতির মূলে আসলে একটি চিত্রই আঁকার চেষ্টা হয়েছে, তা হলো- মানুষের মাঝে যে বিভক্তি তা পুরাকাল থেকে ক্রমবিকশিত হয়েছে। প্রযুক্তি এসে তাকে নানা মোড়কে বাঁধলেও, উদ্দেশ্য-বিধেয় একই রয়েছে। শুধু বিস-ৃতি ঘটেছে এবং কৌশল পাল্টেছে।
যেমন মধ্যযুগীয় লুণ্ঠন-হত্যা-দখলের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কর্মকাণ্ড তথাকথিত শিল্পবিপ্লবকালেও সমভাবে চালু থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস'া প্রচলিত হলেও এ অবস'ার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। মানুষের মাঝে বিভক্তি সূক্ষ্মতর হয়েছে। শাসক ও শোষকের চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেনি। কেবল প্রচার ও প্রকরণের চিত্র পাল্টেছে।
তাই বোদ্ধাজনেরা বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন স্বাধীনতা ও দাসত্ব নিয়ে। তারা স্বাধীনতার সংজ্ঞা খুঁজেছেন কেমন করে মানবসমাজের সবাই একত্রে আনন্দ-মুখ সমভাবে ভাগ করে নিতে পারে। ১৯৬০ সালে মার্কিন নভোপদার্থবিদ ফ্রি এন্টারপ্রাইজের প্রতিষ্ঠাতা অ্যান্ড্রু গালাম্বুস স্বাধীনতার একটি মৌলিক সংজ্ঞা দেন। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা হলো এমন একটি সামাজিক অবস'া, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তির নিজের সম্পত্তির ওপর তার পূর্ণ অধিকার থাকবে। (Freedom is the societal condition that exists when every individual has full (i.e. 100%) control (over his property)। তিনি এই সম্পত্তি বলতে বুঝিয়েছেন একজনের দেহ ও মন। এই দেহ ও মনের ব্যবহারের পূর্ণ অধিকারই হলো স্বাধীনতা। তবে এর ব্যবহার দিয়ে অন্য কারোর অধিকার খর্ব করা যাবে না।
এখন বিশ্লেষণ করে দেখা যাবে, ক্ষমতাবানেরা এই অধিকারটুকু দিতে নারাজ। এর প্রকাশ ঘটে যখন তাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদে সামাজিক অসি'রতার কারণ ঘটে। এই অসি'রতা সৃষ্টি করা হয় বহু পুরনো কোনো ইস্যুকে ঘিরে অথবা সমাজের দুর্বলের ওপর শক্তিশালীদের প্রকাশ্য হামলার মধ্য দিয়ে। এসব কর্মকাণ্ডে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মদদ থাকে। যদি সমাজে গুপ্তহত্যা, খুন, অনাচার বাড়তে থাকে, তখন বুঝতে হবে- রাষ্ট্র এর পৃষ্ঠপোষকতা করছে।
যেমন বাংলাদেশের এমন চিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে যখন তীব্র সমালোচনা হচ্ছে, তখন রাষ্ট্রের একজন মুখপাত্র বলছেন, তিনি গুপ্তহত্যার খবরটি পত্রিকায় দেখেছেন। তার বক্তব্যটি যদি বিখ্যাত ঐতিহাসিক পল কেনেডির মন্তব্যের সাথে বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে এটা স্পষ্ট হবে- রাষ্ট্র এখন অপকর্মের সমালোচনাকেও ভয় পাচ্ছে। কেনেডি লিখেছিলেন, 'When the power losen balance batween butter, guns and investmeats, it is then time for that power to say adieu on the theatre of world history'। অবশ্য এত বড় শ্রদ্ধা এই মুখপাত্রকে দেয়া সঠিক হবে না। তবে যেহেতু তারা এখন ক্ষমতাবান, তারা ইচ্ছে করলে অসি'রতাকে আরো বেগবান করতে পারেন।
এখানেই জনগণের বিপত্তি। সাধারণ মানুষ সাম্রাজ্যের খোঁজ রাখে না। এরা নিরাপত্তা ও প্রতিদিনের খাবারের নিশ্চয়তা পেলেই সন'ষ্ট। এর প্রমাণ এরা শতাব্দীর পর শতাব্দী দিয়ে এসেছে। যখন ক্লাইভের দল ১০০ বজরা ভর্তি করে বাংলাদেশের অর্থ-মণি-মুক্তা মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা হয়ে লন্ডনে নিয়ে গেল, তখন হাজার হাজার মানুষ ভাগীরথীর তীরে ছিল। তারা মাথা ঘামায়নি। কারণ এরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চিত ছিল। এখন সময় পাল্টেছে। ক্ষমতাবানেরা কখনোই সাধারণ মানুষকে নিশ্চিত নিরাপত্তায় থাকতে দিতে চায় না। এতে প্রতিপক্ষের বিরোধীদের সুবিধার ভয় আছে।
তবে একটি বিষয় পুরনো হলেও সাধারণ মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে। তা হলো সংস্কৃতি। একটি বিশ্বাস থেকে এর সৃষ্টি হয়ে সমগ্র জনপদকে সংগঠিত করে। তবে এর পেছনে সাম্রাজ্য গঠনে লিপ্সাও থাকে। এই সংস্কৃতি দিয়ে জনপদের পর জনপদকে একাত্ম করা সহজ। বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষিতে এই প্রচেষ্টা অত্যন্ত দৃশ্যমান। যদি কেউ এই উপসংহার টানতে চান যে, এটা এক অধ্যায়ের শেষের শুরু, তাহলে তাকে মিথ্যা বলা যাবে না। কারণ বর্তমান প্রযুক্তির যুগে সেই সংস্কৃতিই জোরদার যার পেছনে রাষ্ট্র সক্রিয়। এ জন্যই বলা হয়, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ এখন শোষণ-শাসন হয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে। এ আগ্রাসন এত কৌশলী যে, আক্রান্ত জাতি আনন্দের সাথে একে গ্রহণ করে তার স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে। যে রাষ্ট্রশক্তি এই আগ্রাসনকে আহ্বান জানায় অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধকে প্রতিহত করতে, সে বুঝতেই পারে না তারাও বলি হিসেবে পরিগণিত হবে। কারণ যে প্রতিবাদী শক্তি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রতিবাদ করতে পারত, রাষ্ট্র তাকে নির্মূল করে নিজেকেই এই আগ্রাসনের কাছে অসহায় করে তোলে।
বাংলাদেশের বর্তমান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এমন আগ্রাসনকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। ক্লাইভকে মিত্র ভাবলেও মীরজাফর, জগৎ শেঠ, ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভদের শেষ হয়েছিল করুণভাবে।
খুন-গুম-হামলা-মামলা ইত্যাদি সমাজকে করে তুলেছে অসি'র। আর এর ফলে জনগণ এবং স্বাধীনতা হয়েছে বিপন্ন।