পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

অসি'র সমাজ, বিপন্ন মানুষ


২০১১-১২-১৮

স্বাধীনতা সবাই চায় এবং ভালোবাসে। অন্তত এটাই সাধারণ ধারণা। তবে অনেক প্রশ্ন এর সাথে জড়িয়ে থাকে। যেমন স্বাধীনতার অর্থ কী? আমি ক্ষমতাবান বলেই কি আপনার ঘরে প্রবেশ করতে পারব এবং আপনার অর্থ জোর করে কেড়ে নেবো? আপনার বিরুদ্ধে যা ইচ্ছে তা-ই বলতে পারব? যে-কাউকে হত্যা করতে পারব বা অর্থের বিনিময়েই হোক অথবা কারো হুকুমেই হোক?
বর্তমান অবস'াকে একজন পশ্চিমা লেখক চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। তার (ডেভিড ম্যাক গ্রেগরের) মতে, আজকের প্রযুক্তিনির্ভর দুনিয়ায় সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া সমাজে কোনো শক্ত নৈতিকতার ভিত না থাকায়, এসব প্রশ্নের সঠিক ও স্পষ্ট জবাব নেই। অর্থাৎ প্রযুক্তি সর্বপ্রথম নৈতিকতার ভিতকে নড়বড়ে করে দেয় এবং সব বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে প্রথমে যুবা শ্রেণীকে এবং এর সূত্র ধরে পুরো সমাজকে স্বার্থ ও মুনাফা-নির্ভর করে ফেলে। আর এর পথ ধরে আসছে অসি'রতা।
এ অবস'ার উদ্গাতা পশ্চিমা সমাজব্যবস'া হলেও এর প্রচণ্ড ঢেউ এসে পড়েছে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে, যেখানে এই প্রযুক্তি-নির্ভর নৈতিকতাশূন্য আন্দোলন পুরো সমাজব্যবস'াকে অসি'র করে তুলেছে। এই অসি'রতাকে পুঁজি করে ক্ষমতালোভী এবং ক্ষমতাবানেরা হিটলারি কায়দায় প্রচণ্ড প্রচার দিয়ে সাধারণ শান্তি-অন্বেষী মানুষকে বিপন্ন করছে।
এরা দেখেছে পশ্চিমা যৌনতা, অর্থ ও ভোগের বার্তা সমাজের যুবা শ্রেণীকে প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণ করে। এর সম্যক ব্যবহার করে পরিবারব্যবস'াকে ভেঙে এদের ক্ষমতার পথকে নিরঙ্কুশ রাখার প্রচেষ্টায় রত। তবে এরা সবচেয়ে বেশি জোর দেয় সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে অজ্ঞতায় ভরে দেয়ার ব্যাপার। তাই জনগণের কাছে তাদের সমর্থিত তথ্য ছাড়া অন্য কোনো তথ্য যেন পৌঁছতে না পারে, সেই বিশেষ চেষ্টা থাকে। অবশ্য এটি একটি পুরনো ব্যাপার হলেও এর বিকল্প এখনো সৃষ্টি হয়নি। মার্কিনি সংবিধান প্রণেতাদের একজন প্রেসিডেন্ট জেফারসন তার বন্ধু এডওয়ার্ড ক্যারিংটনকে বলেছিলেন, ‘যদি জনগণ তাদের বিষয়ে (পাবলিক অ্যাফেয়ার্স) উদাসীন হয়, তাহলে আমরা, কংগ্রেস ও সংসদ, বিচারক, গভর্নর সবাই নেকড়ে বাঘ হয়ে যাব। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এটাই আমাদের এখন স্বাভাবিক প্রকৃতি হয়ে যাচ্ছে।’ জেফারসনের আরেকজন সহযোগী ড. বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, (জনগণের) অজ্ঞতাই স্বেচ্ছাচারিতা ও জুলুমের সূত্রপাত করে।’ তিনি আরো বলেছিলেন, যে জাতি তথ্যে সুমৃদ্ধ, (ওয়েল ইনফরমড) তাদের দাসত্বে বন্দী করা সম্ভব নয়। যদিও এখন সেই দাসপ্রথা নেই, এর প্রয়োজন সম্ভবত কখনো ফুরাবে না। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র বা মানুষের তৈরি সব শাসনব্যবস'ায় আছে শোষণের কর্মপন'া। আর শোষণ ছাড়াই কেউই দ্রুত বিত্তশালী হতে পারে না। তাই ক্ষমতাবানদের জন্য দাসপ্রথার সুযোগটি প্রয়োজন। অন্য কথায় দাসপ্রথা এখনো আছে, তবে তার প্রকাশ লুকানো। দ্রুত ধনী ও বিত্তবান হতে হলে লুণ্ঠন ও শোষণের বিকল্প নেই। সেই কাজটি এখন স্বার্থপর ক্ষমতাবানেরা কখনো গণতন্ত্রের লেবাস পরে, কখনোবা অন্য তন্ত্র যেমন সমাজতন্ত্রের লেবাস পরে করে থাকে। তাদের অনুগ্রাহী ও হুকুমপালকেরা এক কথায় অতীত দিনের দাস। তবে এসব দাস লুণ্ঠন-শোষণের কিছু ছিটেফোঁটা পেয়ে থাকে। এ কথাই হ্যারল্ড লাসকি বলে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, যে রাষ্ট্রে ধনী-গরিব আছে, সেখানে এমন সরকার গঠিত হবে- যা সাধারণত ধনীদের সুখ-সুবিধা নিশ্চিত করতে ব্যস্ত থাকবে। (A state divided into a small number of rich and a largh number of poor will always develop a government manipulted by the rich protect the amenities represented by their property- Harold Laski) আর এর সাথে যদি গ্যথের বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করা যায়, তাহলে আজকের বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের বহু মানুষের প্রকৃত অবস'ার দৃশ্য পরিলক্ষিত হবে। তিনি বলেছিলেন, ‘তাদের চেয়ে আর কেউই এমন হতাশাব্যঞ্জকভাবে দাসত্বে বন্দী নয়, যেমন- যারা দাস হয়েও ভাবে তারা স্বাধীন ও মুক্ত।’ (None are more hopelessly enslaved than those who falsely believe they are free- Johann Walfgang von Goethe)
এতগুলো উদ্ধৃতির মূলে আসলে একটি চিত্রই আঁকার চেষ্টা হয়েছে, তা হলো- মানুষের মাঝে যে বিভক্তি তা পুরাকাল থেকে ক্রমবিকশিত হয়েছে। প্রযুক্তি এসে তাকে নানা মোড়কে বাঁধলেও, উদ্দেশ্য-বিধেয় একই রয়েছে। শুধু বিস-ৃতি ঘটেছে এবং কৌশল পাল্টেছে।
যেমন মধ্যযুগীয় লুণ্ঠন-হত্যা-দখলের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কর্মকাণ্ড তথাকথিত শিল্পবিপ্লবকালেও সমভাবে চালু থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস'া প্রচলিত হলেও এ অবস'ার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। মানুষের মাঝে বিভক্তি সূক্ষ্মতর হয়েছে। শাসক ও শোষকের চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেনি। কেবল প্রচার ও প্রকরণের চিত্র পাল্টেছে।
তাই বোদ্ধাজনেরা বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন স্বাধীনতা ও দাসত্ব নিয়ে। তারা স্বাধীনতার সংজ্ঞা খুঁজেছেন কেমন করে মানবসমাজের সবাই একত্রে আনন্দ-মুখ সমভাবে ভাগ করে নিতে পারে। ১৯৬০ সালে মার্কিন নভোপদার্থবিদ ফ্রি এন্টারপ্রাইজের প্রতিষ্ঠাতা অ্যান্ড্রু গালাম্বুস স্বাধীনতার একটি মৌলিক সংজ্ঞা দেন। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা হলো এমন একটি সামাজিক অবস'া, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তির নিজের সম্পত্তির ওপর তার পূর্ণ অধিকার থাকবে। (Freedom is the societal condition that exists when every individual has full (i.e. 100%) control (over his property)। তিনি এই সম্পত্তি বলতে বুঝিয়েছেন একজনের দেহ ও মন। এই দেহ ও মনের ব্যবহারের পূর্ণ অধিকারই হলো স্বাধীনতা। তবে এর ব্যবহার দিয়ে অন্য কারোর অধিকার খর্ব করা যাবে না।
এখন বিশ্লেষণ করে দেখা যাবে, ক্ষমতাবানেরা এই অধিকারটুকু দিতে নারাজ। এর প্রকাশ ঘটে যখন তাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদে সামাজিক অসি'রতার কারণ ঘটে। এই অসি'রতা সৃষ্টি করা হয় বহু পুরনো কোনো ইস্যুকে ঘিরে অথবা সমাজের দুর্বলের ওপর শক্তিশালীদের প্রকাশ্য হামলার মধ্য দিয়ে। এসব কর্মকাণ্ডে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মদদ থাকে। যদি সমাজে গুপ্তহত্যা, খুন, অনাচার বাড়তে থাকে, তখন বুঝতে হবে- রাষ্ট্র এর পৃষ্ঠপোষকতা করছে।
যেমন বাংলাদেশের এমন চিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে যখন তীব্র সমালোচনা হচ্ছে, তখন রাষ্ট্রের একজন মুখপাত্র বলছেন, তিনি গুপ্তহত্যার খবরটি পত্রিকায় দেখেছেন। তার বক্তব্যটি যদি বিখ্যাত ঐতিহাসিক পল কেনেডির মন্তব্যের সাথে বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে এটা স্পষ্ট হবে- রাষ্ট্র এখন অপকর্মের সমালোচনাকেও ভয় পাচ্ছে। কেনেডি লিখেছিলেন, 'When the power losen balance batween butter, guns and investmeats, it is then time for that power to say adieu on the theatre of world history'। অবশ্য এত বড় শ্রদ্ধা এই মুখপাত্রকে দেয়া সঠিক হবে না। তবে যেহেতু তারা এখন ক্ষমতাবান, তারা ইচ্ছে করলে অসি'রতাকে আরো বেগবান করতে পারেন।
এখানেই জনগণের বিপত্তি। সাধারণ মানুষ সাম্রাজ্যের খোঁজ রাখে না। এরা নিরাপত্তা ও প্রতিদিনের খাবারের নিশ্চয়তা পেলেই সন'ষ্ট। এর প্রমাণ এরা শতাব্দীর পর শতাব্দী দিয়ে এসেছে। যখন ক্লাইভের দল ১০০ বজরা ভর্তি করে বাংলাদেশের অর্থ-মণি-মুক্তা মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা হয়ে লন্ডনে নিয়ে গেল, তখন হাজার হাজার মানুষ ভাগীরথীর তীরে ছিল। তারা মাথা ঘামায়নি। কারণ এরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চিত ছিল। এখন সময় পাল্টেছে। ক্ষমতাবানেরা কখনোই সাধারণ মানুষকে নিশ্চিত নিরাপত্তায় থাকতে দিতে চায় না। এতে প্রতিপক্ষের বিরোধীদের সুবিধার ভয় আছে।
তবে একটি বিষয় পুরনো হলেও সাধারণ মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে। তা হলো সংস্কৃতি। একটি বিশ্বাস থেকে এর সৃষ্টি হয়ে সমগ্র জনপদকে সংগঠিত করে। তবে এর পেছনে সাম্রাজ্য গঠনে লিপ্সাও থাকে। এই সংস্কৃতি দিয়ে জনপদের পর জনপদকে একাত্ম করা সহজ। বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষিতে এই প্রচেষ্টা অত্যন্ত দৃশ্যমান। যদি কেউ এই উপসংহার টানতে চান যে, এটা এক অধ্যায়ের শেষের শুরু, তাহলে তাকে মিথ্যা বলা যাবে না। কারণ বর্তমান প্রযুক্তির যুগে সেই সংস্কৃতিই জোরদার যার পেছনে রাষ্ট্র সক্রিয়। এ জন্যই বলা হয়, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ এখন শোষণ-শাসন হয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে। এ আগ্রাসন এত কৌশলী যে, আক্রান্ত জাতি আনন্দের সাথে একে গ্রহণ করে তার স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে। যে রাষ্ট্রশক্তি এই আগ্রাসনকে আহ্বান জানায় অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধকে প্রতিহত করতে, সে বুঝতেই পারে না তারাও বলি হিসেবে পরিগণিত হবে। কারণ যে প্রতিবাদী শক্তি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রতিবাদ করতে পারত, রাষ্ট্র তাকে নির্মূল করে নিজেকেই এই আগ্রাসনের কাছে অসহায় করে তোলে।
বাংলাদেশের বর্তমান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এমন আগ্রাসনকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। ক্লাইভকে মিত্র ভাবলেও মীরজাফর, জগৎ শেঠ, ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভদের শেষ হয়েছিল করুণভাবে।
খুন-গুম-হামলা-মামলা ইত্যাদি সমাজকে করে তুলেছে অসি'র। আর এর ফলে জনগণ এবং স্বাধীনতা হয়েছে বিপন্ন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন