পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

অবিচারের বিরুদ্ধে বলার সময়


২০১১-১১-১৫

বিশ্বব্যাপী এখন যে ৯৯ শতাংশের আন্দোলন চলছে, তার ঢেউ এখনো বাংলাদেশে তেমনভাবে আছড়ে পড়েনি। হয়তোবা এ জন্য যে, বাংলাদেশের শোষক শাসক লুটেরাদের অংশ এক থেকেও কম, অথচ তারা এত শক্তিশালী এবং সংগঠিত যে, যারা এদের বিরুদ্ধে তাদের আর্তি জানাবে, তারাও এই অর্ধ শতাংশের (ধরা যাক) হয়ে নিজেদের বিরুদ্ধেই কাজ করছে।
এক শতাংশের আর্তির শুরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটে। এটাকে বিশ্বের আর্থিক রাজধানীও বলা চলে। বিশ্বের এমন কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই, যা এখান থেকে অবলোকন, বিশ্লেষণ এবং পরিচালনা করা হয় না। এমনকি রাজনীতিও। এবং এ সবের একটিই উদ্দেশ্য, তা হলো মুনাফা। এই মুনাফাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বে করপোরেট সংস'া বলে পরিচিত। এদের উত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই, যদিও তখন অন্য নামে পরিচিত ছিল। এ মুনাফার জন্য তারা তখন অগণিত রেড ইন্ডিয়ানকে হত্যা করে, দাস ব্যবসা চালু করে, যুদ্ধ শুরু করে। এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও কেন এদের বিরুদ্ধে বিশাল প্রতিবাদ হয়নি? কারণ তারা অত্যন্ত সজাগ। যারা মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছাতে পারে, তাদের সংগঠিত করতে পারে অথবা কোথাও কেউ কোনো নতুন আবিষ্কার করল, যা তাদের স্বার্থের বাইরে অথবা তার সাথে সংঘাত হতে পারে, তেমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তারা সর্বতোভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই তাদের বিরুদ্ধে শুধু তারাই বক্তব্য দিতে পারছে বা দিচ্ছে, যা বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নেতৃত্বে বা নিয়ন্ত্রণে নেই।
এবার কেন এই ৯৯ শতাংশ বলে পরিচিতদের কেউ কেউ ওয়াল স্ট্রিটের সামনে ধরণা দিল? যাকে তারা বলছে দখল। দিনের পর দিন এদের বিস-ৃতি ঘটছে। এমনকি শিল্পোন্নত দেশের প্রায় প্রত্যেকটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার অধ্যাপক রবার্ট জেনসেন আল জাজিরায় মন্তব্য করেছেন, এই ওয়াল স্ট্রিটের দখলকারীরা এখনো কোনো দাবি তোলেনি। শুধু তারা দেখিয়ে দিয়েছে তাদের যন্ত্রণাগুলো। তবে তিনি বলেছেন, যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তারা তাদের বিত্ত ও বিশেষ সুবিধার আড়ালে নিরাপদে থাকলেও, তারা বুঝতে পেরেছে এই প্রতিবাদকারীরা সঠিক।
উন্নত বিশ্বের সাধারণ মানুষকে এই এক শতাংশরা এ কথা বলে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল যে, তারা (সাধারণ মানুষরা) নিশ্চিত, কারণ রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস'ানের ব্যবস'া করেছে। তারা তা বিশ্বাস করে, তাই এর বিপক্ষে কেউ কিছু বললে তা বিশ্বাস করত না। বিশেষ করে সে বক্তব্যগুলো যেখানে স্পষ্ট করে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে, কেমনভাবে মাত্র এক শতাংশ মানুষ তাদের সম্পদ ও সুখ আনন্দ নিরঙ্কুশভাবে ভোগ করছে। এবারের অর্থনৈতিক সঙ্কটের পরে যখন তারা দেখল তাদের নিরাপত্তা, জীবন ধারণের ব্যবস'া, চাকরি, বাসস'ান, এমনকি খাবারের সংস'ান একেবারেই ভঙ্গুর ও অনিশ্চিত, তখনই এই ওয়াল স্ট্রিটের আন্দোলনকারীদের বক্তব্যে তারা সাড়া দিল। যদিও এখানে তৃতীয় বিশ্বের সেই ভয়াবহ দৃশ্যগুলোর প্রকাশ্য পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না, তবুও ধরপাকড়গুলো, তৃতীয় বিশ্বের মতো পুলিশের অতি বাড়াবাড়িগুলো জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আর ধীরে ধীরে এ আন্দোলন প্রথম বিশ্বে বহু দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
এর কারণ আগেই বলা হয়েছে, তবে তিনজন বিখ্যাত লেখক এবং চিন্তাবিদ এর চমৎকার ঐতিহাসিক বর্ণনা দিয়েছেন। তারা হলেন, এমিরিটাস অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি, অধ্যাপক মাইকেল প্যারেন্টি এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাবেক বৈদেশিক সংবাদদাতা ক্রিস হেজেস। এর মাঝে পুলিশ ক্রিস হেজেসকে এবং আরো ১৬ জনকে গত সপ্তাহে গোল্ডম্যান স্যাকসের সামনে (ওয়াল স্ট্রিটে অবসি'ত) প্রতিবাদ সভা থেকে গ্রেফতার করে। অধ্যাপক ড. করনেল ওয়েস্টের সাথে ক্রিস এখানে যৌথ সভাপতিত্ব করেছিলেন। পরে এক বিবৃতিতে ক্রিস বর্তমানের মার্কিন আর্থিক সঙ্কটের কারণ বর্ণনা করেন। এ সঙ্কট থেকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হয়েছে।
ক্রিস বলেছেন, বর্তমানের বিশ্ব মন্দা ও মূল্যস্ফীতির প্রধান নায়ক গোল্ডম্যান স্যাকস। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গোল্ডম্যানই বর্তমান আর্থিক সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি সরকারি সাহায্য পেয়েছে। এমনকি তাকে ব্যাংক হোল্ডিং কোম্পানি হিসেবে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে যখন গোল্ডম্যান সরকারি সাহায্য পাচ্ছিল, তখন কোম্পানিটি তার টপ এক্সিকিউটিভদের (ওপরের তলার কর্মচারী) ২০০৯-২০১১ সালে মোট ৪৪ বিলিয়ন ডলার বোনাস দেয়। এ তিন বছরে মার্কিন সরকার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তত ১৪ ট্রিলিয়ন (১৪ লাখ কোটি) ডলার সহায়তা দেয়। ক্রিস উল্লেখ করেছেন, (গাল্ডম্যান) বিশ্বের পণ্যমূল্য নির্দেশক (কমোডিটি ইনডেক্স) হিসেবে চাল, গম, চিনি, পশু সম্পদ ও শস্যের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। অর্থাৎ তারা ইচ্ছেমতো মুনাফার খাতিরে খাদ্যশস্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে বিশ্বের কোটি কোটি গরিব মানুষের খাদ্য কেনা তাদের সাধ্যের বাইরে চলে যায়। গোল্ডম্যান প্রতিটি মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী ফান্ডে প্রচুর দান করে। ফলে তারা যে আইন বা সুবিধা চায়, তা পেতে কোনো বেগ পেতে হয় না। যেমন ২০০০ সালে তদানীন্তন সরকার, ‘কমোডিটি ফিউচারস মডারনাইজেশন অ্যাক্ট’ পাস করল, যার ফলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ওপর যে বাধানিষেধ ছিল, তা উঠে গেল। তখন থেকেই বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পণ্যের, বিশেষ করে খাদ্যশস্যের মূল্য দ্রুত বাড়তে থাকল। এক শতাংশের পকেট মুনাফায় ভর্তি হতে থাকল, আর অবশিষ্ট ৯৯ শতাংশের জীবন সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ল। এর ওপর মার্কিন সিনেট সাব কমিটি ৬৫০ পৃষ্ঠার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পেশ করলেও দোষী কাউকে শাস্তি পেতে হয়নি। ক্রিস বলেছেন, এসব কর্মকাণ্ডের ফলে এবং বিভিন্ন সুবিধা পাওয়ার জন্য গোল্ডম্যান স্যাকসসহ সব আর্থিক এবং ব্যাংক প্রতিষ্ঠান অন্তত ৪০ ট্রিলিয়ন (৪০ লাখ কোটি) ডলার মুনাফা করে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে এ পরিমাণ গরিব করে। আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ২০ শতাংশ বেকার (যদি সরকারিভাবে তা ৯ শতাংশ)। এর জন্য পুরোপুরি এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দায়ী।
অবশ্য অধ্যাপক চমস্কি বিষয়টি একটু ঐতিহাসিকভাবে বিশ্লেষণ করে বলেছেন, যে ৯৯ শতাংশ আন্দোলন শুরু হয়েছে তা বিশ্বব্যাপী আরো ব্যাপকভাবে হতে হবে, যদি আমরা সুন্দর ভবিষ্যতের একটি সুযোগ চাই। তিনি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উল্লেখ করেছেন, ১৯৩০ সালের মার্কিন মন্দার সময় সাধারণ মানুষ বিশেষ করে শ্রমিক আন্দোলনের ফলে একটি আশার সৃষ্টি হয়েছিল যে, মন্দার সময় কেটে যাবে। কিন' এবার মানুষের মাঝে এমন হতাশার সৃষ্টি হয়েছে যে, আন্দোলনও জমছে না। এমন অবস'া একেবারেই নতুন।
চমস্কি উল্লেখ করেছেন, বর্তমান অবস'ার সূত্রপাত হয় ৭০-এর দশক থেকে। তার আগে ব্যাংকগুলোর কর্মকাণ্ড ব্যাংকের মতোই ছিল। ৫০-৬০ দশকে বিশাল শিল্পায়ন হয়। সৃষ্টি হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এবং তার সংখ্যা বাড়ছিল। কিন' ৭০ দশকে এসে এর পরিবর্তন ঘটে। শিল্পায়ন বন্ধ হয়ে গেল আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে সব সম্পদ জমা হতে থাকল। এদিকে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির (ইন্টারনেট কম্পিউটার) উন্মেষ ঘটল, সম্পদ সাধারণের কাছ থেকে স্বল্প কিছু মানুষের কাছে জমা হতে থাকে। আর নির্বাচনী ব্যয় বাড়তে থাকে। এই আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং স্বল্পসংখ্যক ধনীরা সে নির্বাচনী ব্যয়ে অংশ নেয়ার ফলে রাজনৈতিক দলগুলো পুরোপুরি এসব প্রতিষ্ঠানের বশংবদ হয়ে গেল। এসব প্রতিষ্ঠান শুধু রাজনীতিই নয়, বিচার ব্যবস'াসহ সব প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পায়। আর শ্রমিক আন্দোলনসহ সব রকমের আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে গেল। এমনকি করারোপসহ সকল প্রকারের সরকারি আর্থিক কর্মকাণ্ডকে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকল। সরকারের বিভিন্ন নিয়োগেও তারা নাক গলাতে থাকল।
চমস্কি বলেছেন, এদের সংখ্যা এক শতাংশ নয়। তার চেয়েও অনেক কম। হয়তোবা এক শতাংশের দশ ভাগের একভাগ। তিনি মন্তব্য করেছেন, মজার কথা এ চিত্র বিশ্বের সব দেশ অনুকরণ করতে থাকে। ফলে প্রতিটি দেশেই এখন দু’টি ভাগ। এক শতাংশ ভাগ্যবান, ক্ষমতাশালী লুটেরা, আর ৯৯ ভাগ অভাগা, নিষ্পেষিত এবং শোষিত। এক শতাংশ এখন এতই শক্তিশালী যে, জনগণের ইচ্ছাকে অনায়াসেই উপেক্ষা করতে পারে। চমস্কি বলেছেন, ঠিক এ অবস'ার কথা অ্যাডাম স্মিথ এবং ডেভিড রিকার্ডো তাদের বইতে উল্লেখ করেছিলেন। চমস্কির আরেকটি ভয়ঙ্কর সতর্কবাণী হলো- এসব করপোরেট যুদ্ধবাজ একপর্যায়ে আণবিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্য তাদের মক্কেল সরকারকে উৎসাহিত করতে পারে। তাতে তাদের মুনাফা। তেমন হলে, তা মানুষের অস্তিত্বকেই অনিশ্চিত করবে। এ ছাড়া আবহাওয়া পরিবর্তনে শিল্পোন্নত দেশগুলো বিশেষভাবে ত্বরান্বিত করছে। অনেক বিজ্ঞানী এরই মাঝে দাবি করেছেন, মানব সভ্যতা ধ্বংস এখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। হয়তোবা কিছুদিন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। এ বক্তব্যের সাথে একমত হয়েছেন অধ্যাপক মাইকেল প্যারেন্টি। মানুষের কথা বলার জন্য তাকে আমেরিকার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি দমে না থেকে গত তিন দশক ধরে লিখছেন আর আন্দোলনে রত রয়েছেন। মাইকেল দাবি করেছেন, আজকের বিশ্বের মানুষে মানুষে বৈষম্যের মূলে রয়েছে মার্কিন নেতৃত্বে বিশ্ব মুক্তবাজার পদ্ধতি। এ পদ্ধতি এখন এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে, কোনো দেশ এর বাইরে থাকলে চাইলে তাকে অচ্ছুৎ করা হয় এবং তার সরকারকে হয় যুদ্ধ নতুবা আর্থিক দিক দিয়ে একঘরে করে সরিয়ে দেয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন মিসরের নিষ্ঠুর একনায়ককে কেমনভাবে যুগের পর যুগ ধরে লালন করা হয়েছে, আর যারা সহযোগিতা করেনি যেমন হুগো শ্যাভেজকে একঘরে করা হয়েছে। প্যারেন্টি এ জন্য খানিকটা মার্কিন জনগণকে দায়ী করেছেন। যদি কোনোমতে তাদের (মার্কিন জনগণকে) বোঝানো যায়, কোনো দেশে রাক্ষস (ডিমন) রয়েছে, তাহলে তারা তাদের সরকারকে সেই দেশের জনগণের ওপর যুদ্ধসহ সব রকমের অত্যাচার, অনাচার, যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে সম্মতি দেবে।
অবশ্য সেই জনতা এখন এই ঘন পর্দার আড়ালে যে এক শতাংশ রয়েছে, তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বলেই ওয়াল স্ট্রিটে প্রতিবাদের মহড়া চলছে। তারা এখন আর পুঁজিবাদকে পবিত্র বলে মনে করছে না। সরকারের সব কর্মকাণ্ডে তাদের যে অটুট বিশ্বাস এবং সমর্থন ছিল, তাতে চিড় ধরেছে। যেমন চমস্কি ভেবেছেন, এ ধারাকে যদি জিইয়ে রাখতে হয়, তাহলে আরো পরিশ্রম করতে হবে, নতুবা শক্তিশালী একাংশ এ প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করতে সক্ষম।
এই চিত্রের বাস্তবতায় বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের অবস'া কেমন? এক কথায় ভয়াবহ। উন্নত দেশের একাংশ শোষকদের আইন ইত্যাদির ছদ্মাবরণে তাদের লুট, শোষণ চালাতে হয়। এমনকি শোষিতরাও তাতে সহায়তা করে। কিন' তৃতীয় বিশ্বের লুটেরাদের এমন ভড়ংয়ের প্রয়োজনীয়তা নেই। তারা নিছক পেশিশক্তি ও ক্ষমতা ব্যবহার করে তাদের লুণ্ঠন ও শোষণ চালিয়ে যায়। ফলে দারিদ্র্যের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ একটি চমৎকার প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন, গত ৪০ বছরের স্বাধীনতা আমলে দরিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৭১ সালে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। চল্লিশ বছর পর এই দরিদ্রের সংখ্যা (ইউএনডিপির ফরমুলা অনুসারে) বেড়ে হয়েছে ১২ কোটি। তাহলে কত পথ পার হলাম, কোন দিকে আমরা যাচ্ছি, তিনি প্রশ্ন করেছেন।
অবশ্যই এই প্রশ্নের জবাব পেতে হবে। কারণ ক্ষমতাসীনরা প্রায়ই আবেগ এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে প্রচার আর আন্দোলনে জনগণকে ব্যস্ত রেখে তাদের স্বার্থ পূরণে ব্যস্ত থাকে। ফলে বাংলাদেশের দরিদ্ররা অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের ভাষায় ‘পশুর দারিদ্র্যসীমার’ (এনিম্যাল পভারটি লাইন) নিচে। অর্থাৎ এ দারিদ্র্যের সমকক্ষ আর কোনো দারিদ্র্য নেই। কারণ শুধু খাবারের অভাবের দরিদ্র ১২ কোটি হলে, সবার শিক্ষা, স্বাস'্য, বাসস'ান, নিরাপত্তাসহ সব অধিকারের হিসাব ধরলে চিত্রটি হবে আরো ভয়াবহ। অথচ এক শতাংশের কম মানুষ সব অধিকার, সম্পদ কুক্ষিগত করে নিয়েছে, আর জনগণের ইচ্ছেকে পদদলিত ও উপেক্ষা করছে।
তাই ওয়াল স্ট্রিটের আন্দোলনকারী এবং সচেতন সংবেদনশীল চিন্তাবিদদের সাথে সুর মিলিয়ে বলতেই হবে- চোর, দস্যু, হত্যাকারীদের প্রতিরোধ করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুবা চমস্কির ভাষায় সুস' সুন্দর জীবন তো নয়ই, এমন অগ্রহণীয় অবস'ায় মানবজাতি পতিত হবে, সেখান থেকে ফেরার পথ থাকবে না। একজন লেখক এর চমৎকার উপমা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই এক শতাংশের কর্মকাণ্ড ক্যান্সার ভাইরাসের মতো, যা আশ্রয়কর্তাকেও পরিশেষে নিধন করে।
অবশ্যই রস কাপুটির মত এ অর্ধাংশে অনুভূতি জাগুক। কাপুটি ইরাকে ফালুজার হত্যাকাণ্ডে মার্কিন বাহিনীর ভেটারান। তিনি বলেছেন, ‘আমি ইরাকের হত্যাকাণ্ড দিয়ে আমার দেশকে সেবা করিনি। আমি এক্সন-মবিল, হ্যালিবারটনের সেবা করে হাজার হাজার ইরাকি এবং একটি শহর (ফালুজা) ধ্বংস করেছি। তাই বলতে চাই যুদ্ধে যাবার জন্য আমরা কোন বীর নই। ...এখনই অবিচারের বিরুদ্ধে বলার সময় এসেছে।’
আসলে এই একাংশরা কত ধনী তার এক সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক নিবন্ধে জর্জ মনবিও। তিনি লিখেছেন, ‘ইতিহাসের সবচে’ ধনী ব্যক্তি কার্লোস স্লিম এখন মেক্সিকোতে বাস করেন। এ হিসাব রোমানদের আমল থেকে এ পর্যন্ত। তার হিসাবের নিক্তি একটু অন্য রকমের। ধনী ব্যক্তিটি কতজনের শ্রমকে কিনতে সক্ষম? তার মতে, স্লিম, ৪৪০,০০০
লোকের শ্রম কিনতে পারেন। সে হিসাবে তিনি কার্নেগির চেয়ে নয় গুণ ধনী এবং রকফেলারের চাইতে চার গুণ বেশি ধনী। তিনি একটু কড়া কথাই বলেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যম, থিঙ্কট্যাঙ্ক ও সরকারগুলোর প্রতি অনুরোধ করেছেন, এই একাংশের ভাঁড়ামি বন্ধ করুন। নতুবা সৃষ্টিকর্তার অমোঘ বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন