অ্যাগেইনস্ট এম্প্যায়ার গ্রনে'র লেখক মাইকেল প্যারেন্টি লিখেছেন, ‘এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার কিছু দেশকে তৃতীয় বিশ্ব বলে আমাদের ডাকতে বলা হয় কারণ তারা দরিদ্র।’ তিনি বলেছেন, এ বক্তব্যের পেছনের যুক্তি হলো এসব দেশের জমি অনুর্বর আর মানুষেরা মূল্যহীন। এটা ঐতিহাসিক ঘটনা। প্যারেন্টি বলেন, এটা সত্য নয়। কারণ, তা যদি হতো, তবে ইউরোপিয়ানরা সব কষ্ট সহ্য করে এসব তৃতীয় বিশ্ব দখল করতে গেল কেন? এ জন্য যে, এ তৃতীয় বিশ্ব তাদের চেয়ে ধনী ছিল। তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ সম্পদ ও খাদ্যসম্ভার তাদের প্রলুব্ধ করেছিল। গরিব দেশে গিয়ে কেউ নিজকে ধনী বানাতে পারে না, প্যারেন্টি লিখেছেন। সেই যে সম্পদ লুণ্ঠন শুরু হলো, তা আজো শেষ হয়নি। আর এই লুণ্ঠনপ্রক্রিয়াতে ব্যবহার করছে তাদের নিজেদের তৈরি নিয়ম, নীতি, পদ্ধতি। এরই পথ ধরে এসেছে সাম্রাজ্যবাদ এবং তা টিকিয়ে রাখতে সৃষ্টি হয়েছে ফ্যাসিবাদ। আর ফ্যাসিবাদকে ব্যবহার করা হচ্ছে গণতন্ত্রের আড়ালে, স্বৈরশাসক সৃষ্টির মাধ্যমে। এর মাঝে তথাকথিত গণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকের সংখ্যাই বেশি। প্যারেন্টির মতে, এই ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকেরা’ বেশি চাকরগিরিতে সক্ষম। কেননা দুর্নীতিবাজ চাকরদের মতো তারা অবৈধ কর্মকাণ্ডের ভাগ পান। এগুলো ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সম্পদের লুণ্ঠন।
যে কারণে এখন এটা সার্বজনীন সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ যত দুরূহ এবং পথ যেমন দীর্ঘ, তেমনি তা নস্যাৎ করা তত সহজ এবং সময় হলো সংক্ষিপ্ততম। আর এটাও এখন ঐতিহাসিক সত্য, গণতন্ত্রের বিসর্জন হয়ে থাকে গণতান্ত্রিক পথেই। গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারেরা এ কাজটি করে থাকে ফ্যাসিবাদের হাত ধরে। এ নিবন্ধে এই স্বৈরাচারেরা গণতান্ত্রিক লেবাসে মুসোলিনির দশটি পথ কেমনভাবে ব্যবহার করে তার একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যায়। এ সবই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টায়- আবার গণতান্ত্রিক লেবাসে। আসলে সমস্যাটা সৃষ্টি করেছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ। তারা রাজতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণে আনতে আট শ’ বছর নানা খড়কাঠি পুড়িয়ে গণতান্ত্রিক ধারার সৃষ্টি করেছিল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, যেখানে ক্ষমতা থাকবে জনগণের হাতে এবং একে গণতন্ত্র বলা হবে। প্রমাদ গুনল ক্ষমতাপ্রয়াসীরা। তারা গণতন্ত্রের ধারায় ক্ষমতা ভোগের পক্ষপাতী ছিল না। তাই তারাই সৃষ্টি করতে থাকল নতুন নতুন উপসর্গ, যার মাধ্যমে জনগণ তাদের অধিকার একটু একটু করে ছাড়তে থাকল এবং তা কখনো যে ছিল বা এখনো তাদের অধিকার আছে তা-ও ভুলতে শুরু করল।
এবারের ওয়াল স্ট্রিট দখলের মহড়ার মাঝ দিয়ে একটি জিনিস প্রকাশ পেয়েছে। তা হলো, এখন পশ্চিমা জনগণ তাদের অধিকারের কথাও সঙ্ঘবদ্ধভাবে বলতে পারছে না। তাহলে পশ্চিমাদের তৈরি তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের অবস'া, বিশেষ করে যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই বা তার বদলি কর্মকাণ্ড চলছে এবং গণতান্ত্রিক অ্যাজেন্ট দিয়ে শাসন চলছে, তার চিত্র কত ভয়াবহ হতে পারে তার মাত্র একাংশ নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমেও প্রচারিত হচ্ছে। ওয়াল স্ট্রিটের প্রতিবাদকারীরা বলতে চাইছেন, মার্কিন মুলুকের একাংশ যেসব সম্পদের অধিকাংশ ভোগ করছে তার অংশ অপর ৯৯ শতাংশের সাথে ভাগ করে ভোগ করতে হবে। কিন' এ কথা তাদের স্পষ্ট করে বলতে দেয়া হচ্ছে না। হাফিংটন পোস্টে প্রকাশিত এ নিবন্ধে বলা হয়েছে প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো খবরগুলো সঠিক প্রচার করছে না। বিখ্যাত বিশ্লেষক রবার্ট শিয়ার বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান আর্থিক সঙ্কটের যে প্রতিবাদ হওয়া উচিত তার কণাকানিও এই ওয়াল স্ট্রিটের প্রতিবাদকারীরা করেননি। তিনি কংগ্রেসনাল বাজেট অফিসের রিপোর্ট উল্লেখ করে বলেন, এই এক শতাংশ ধনীদের আয় ১৯৭৯-২০০৭ মধ্যে ২৮০ শতাংশ বেড়েছে অথচ অপরাংশের আয় কমে গেছে। শিয়ার বলেন, এই প্রতিবাদকারীদের বক্তব্য প্রথম তুলে ধরেন বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিটস। তার ‘অব দি ১% বাই দি ১% ফরদি ১%’ নিবন্ধে একটি কড়া মন্তব্য করেছেন। মার্কিনিরা অন্য দেশের নির্যাতনকারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গভীরভাবে অবলোকন করার সুযোগ পায়। এসব সরকার মাত্র কিছু মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত করার সুযোগ দেয়। অথচ তাদের দেশের মাত্র ১% মানুষ যে ৪০% সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে তার খবর রাখে না। যারাই সামান্য কিছু বক্তব্যও দিচ্ছে তাদের কারারুদ্ধ করা হচ্ছে। এমনিভাবে কারারুদ্ধ হলেন বিখ্যাত লেখিকা, নারী আন্দোলনকারী নাওমি উলফ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নিষিদ্ধ যায়গায় দাঁড়িয়েছিলেন। উলফ ম্যানহাটানে স্কাইলাইট স্টুডিওর সামনে ফুটপাথে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি ‘গেম চেঞ্জার অব দি ইয়ার’ পুরস্কার অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। নিউইয়র্ক স্টেটগভর্ণর অ্যামড্রিড কুন্ডমোকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। এ অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন হাফিংটন পোস্ট পত্রিকা, যেখানে উলফ নিয়মিত লেখক। এ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বিখ্যাত ব্যক্তিরা। যারা স্কাইলাইট স্টুডিওর সামনে জড়ো হয়েছিলেন, তারা গভর্নর কুয়োমোর ট্যাক্স প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে এসেছিলেন। পুলিশ তাই ফুটপাথ খালি রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। সব চলাচল বন্ধ করে। তবে নাওমি উলফকে আটক করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নেয়ার ঘটনাটি প্রতিবাদকারীদের জন্য শাপে বর হলো। সারা বিশ্বের প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো ওয়াল স্ট্রিট দখলের খবরে আগ্রহান্বিত হলো আর প্রথমবারের মতো সরকারি প্রচারের অসত্য তথ্যের আলোচনার সূত্রপাত হলো।
আসলে নাওমি উলফ সাধারণ মানুষের জন্য লিখছেন, বিক্ষোভ মিছিল, বক্তৃতায় অংশগ্রহণ করছেন। তার একটি বিখ্যাত বক্তৃতা ছিল ফ্যাসিবাদের ওপর। তিনি দেখিয়েছেন কেমন করে ফ্যাসিবাদ ধীরে ধীরে গণতন্ত্রকে গ্রাস করে নিয়েছে। আর এখন এই গণতন্ত্রের লেবাস পরে ফ্যাসিবাদের মন্ত্র ও কর্মকাণ্ড চালিয়ে ক্ষমতাসীনদের সব অপকর্ম ও জনবিরোধিতার হাতিয়ার হয়ে গেছে। প্রায় চার বছর আগে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যেন হলে ‘ফ্যাসিবাদের পথে’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় চমৎকারভাবে আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীনেরা কেমনভাবে স্বৈরশাসক হচ্ছেন, একনায়কত্বের পথ অনুসরণ করছেন এবং ক্ষমতাসীন দলকে সে পথে চলতে বাধ্য করছেন তার বিশদ বর্ণনা দেন। তারা সর্বদা গণতন্ত্রের কথা বলছেন। প্রচণ্ড প্রচার চালাচ্ছেন কেমনভাবে তাদের পূর্বসূরিরা তা হরণ করেছিলেন এবং কেমনভাবে তাদের বর্তমান প্রতিপক্ষ ও প্রতিবাদকারীরা গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সংবিধানকে একটি গোপন দলিলে পরিণত করেছেন যেন জনগণ তাদের অধিকার সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর না রাখে অথবা এমন ভীতিকর অবস'ার সৃষ্টি করা হয় যাতে তারা তেমন কোনো খোঁজও না নিতে পারে, এমনকি ইচ্ছেও করে। তারা একদল অধ্যাপক, আইনজ্ঞদের কাছে এ বিষয়টি তুলে দিয়ে দাবি করেন, এটা অন্য কোনো বিশেষজ্ঞ বা অনুসন্ধানকারীদের বিষয় নয়। আর সংবিধানের নানা পরিবর্তন করেন কখনো বশংবদ পার্লামেন্টকে দিয়ে, কখনো বা বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে প্রশাসন-ক্ষমতাকে নিবৃত্ত রাখার সব বাধানিষেধ (চেক অ্যান্ড ব্যালান্স) ভেঙে ফেলা হয়। সে কথা সাধারণ নাগরিক অনুভবও করতে পারে না।
(১) এ পদ্ধতিগুলোর প্রথম পদক্ষেপ হলো ভেতর ও বাইরের ভয়াবহ শত্রুর উপসি'তির ঘোষণা করে প্রয়োজনীয় আইন পাস করো, যা দিয়ে উদ্দেশ্য সাধনে বাধা হতে পারে এমন ব্যক্তি ও শক্তিকে রাষ্ট্রীয় শক্তি দিয়ে দমন বা নির্মূল করো। তিনি মার্কিনিদের প্যাট্রিয়টিক অ্যাক্টের বিষয় তুলে ধরে বলেন, এই আইনটি পাসের সময় কংগ্রেসে প্রায় কোনো আলোচনাই হয়নি। মার্কিনিদের এমন ভীতির মধ্যে ঠেলে দেয়া হয় যে তারা তাদের সব ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও অধিকার ছেড়ে দিতে প্রস'ত হয়। অথচ গত তিন শতাব্দীতে কখনো সে দেশ কোনো বৈদেশিক আক্রমণের সম্মুখীন হয়নি। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অন্তত পাঁচ ডজন দেশ আক্রমণ করেছে, এবং তাতে লাখ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটেছে। তিনি বলেছেন, নাজিরা কমিউনিস্টদের ভয় দেখায়, এখন ‘ইসলামি সন্ত্রাসী’ ভয় সমগ্র বিশ্বব্যাপী। এ ব্যাপারে উইলিয়াম ব্লাস তার রোগ স্টেট বইতে বলেছেন, এমনকি আমাদের শত্রুরাও আমাদের মিথ্যা কথায় বিশ্বাস করে।
শুধু মার্কিন মুলুকে নয়, সারা বিশ্বেই এ জুজুর ভয় দেখিয়ে, কখনো বা গোপনে ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়ে সাধারণ মানুষকে ভীতির মাঝে রেখে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকছে এসব ক্ষমতালোভী। তারা সবার অধিকার এভাবে কেড়ে নিচ্ছে। এমনকি বিচার, বিচারক সবাই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিকারীদের এই মিথ্যার সাথে সহযোগিতা করছেন অথবা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
(২) এর পরের পদক্ষেপ হচ্ছে রাশিয়ার কুখ্যাত গুলাগ সৃষ্টি। রাশিয়ার কমিউনিস্টরা ১৯৩৩ সালে এর ব্যাপক প্রচলন করে। সমগ্র দেশটিই যেন একটি কারাগার। পুলিশ, বিচারালয় ও সরকারি দলের কর্মীরা নিজেরাই অভিযোগকারী, বিচারক ও শাস্তিদাতা হয়েছিল। নাজিরা এ ব্যাপারে আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। যদি কেউ, এমনকি সংবাদকর্মী কারো ব্যাপারে কিছু লিখল এমন হতো সে-ই ট্রাইব্যুনালের প্রধান হয়ে গেল। জার্মানিতে সে সময় এত ট্রাইব্যুনাল ছিল যে সাধারণ মানুষ ভয়ে মুখ খুলত না। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ২৪ এপ্রিল ১৯৩৪। নাজিরা ‘জনতার আদালতের’ সূত্রপাত করল। এগুলো কোনো আইন দ্বারা পরিচালিত হতো না। তারা ইচ্ছেমতো প্রতিপক্ষ বা যে কাউকে ধরে মাসের পর মাস আটকে রাখত, অত্যাচার করত। এমনকি বন্দীরা মৃত্যুবরণ করতেন। যারা নাজি পদ্ধতি, নীতি বা তাদের কর্মকাণ্ডের সামান্যতম সমালোচনা করতেন, তাদের ওপর নেমে আসত চরম বিপর্যয়। এ অবস'া এখন বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে। এখন এসব গুলাগ যেমন গুয়ানতানামো বে সম্পর্কে এমন প্রচারণা চালানো হয় যেন মানুষ ভাবতে শুরু করে এখানে এ দেশের মানুষ থাকে না। একপর্যায়ে এখানের বাসিন্দা হয় সুশীলসমাজের সদস্য, বিরোধী দলের সদস্য, লেবার, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ সবাই। ইতালি, জার্মানি, ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়ার দেশগুলোতে তাদের অবসি'তি উল্লেখযোগ্য।
(৩) এর পরের পদক্ষেপ আরো ভয়াবহ। এরা হলো পেটোয়া বাহিনী। সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতায় যুবকদের এই বাহিনীতে জড়ো করা হয়। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখল করে, তাদের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অঙ্গেও ঢোকানো হয়, যেমন- পুলিশ, গোপন দল ইত্যাদি। আবার এদের নিয়ে কিছু প্যারামিলিটারি দলও তৈরি করা হয়। এরা সাধারণত আইনের ঊর্ধ্বে থাকে। নাওমি বলছেন, এসব দল গণতন্ত্রে সবচেয়ে প্রয়োজন, যেন জনগণ কোনো মতামত যৌথভাবে নিতে না পারে; বিশেষ করে যদি তা সরকারবিরোধী হয়। এমনকি এদের ছত্রছায়ায় ভাড়াটে সৈন্যরাও কাজ করে।
(৫) মুসোলিনির ইতালি, হিটলারের জার্মানি এবং কমিউনিস্টদের দেশের খবরদারি পদ্ধতিটি ফ্যাসিবাদীর প্রধান স্তম্ভ। এই গোয়েন্দাগিরি এখন সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষের সব ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে এটা খানিকটা অমার্জিত। তবে উন্নত বিশ্বে প্রযুক্তির সাহায্যে এর ব্যবহার ব্যাপক। সরকার সব রকম দল, গোষ্ঠীতে অনুপ্রবেশ করে তাদের কর্মকাণ্ডকেও কখনো কখনো প্রভাবিত করে থাকে। এর সপক্ষে নানা আইনও পাস করা হয়েছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন পশু অধিকারের জন্য কোনো প্রতিবাদ হলে এটাকে সন্ত্রাস বলে আখ্যায়িত হয়। নাওমি বলেছেন, সন্ত্রাসের সংজ্ঞার এখন কোনো সীমারেখা নেই।
(৬) ফ্যাসিবাদীর ষষ্ঠ পদক্ষেপ একইভাবে মারাত্মক। এ নীতিতে ‘যাকে ইচ্ছে ধরো এবং যাকে ইচ্ছে ছাড়ো’ পদ্ধতির দলে প্রয়োজনীয় ভীতির রাজ্য কায়েম করা যায়। যেমন সরকার ঠিক করবে কোন ব্যক্তিকে হেনস্তা করা হবে। তাকে আটক করে নানা অপবাদে অপদস' করা হলো এবং বশংবদ সংবাদমাধ্যম তা যত্নসহকারে প্রচার করতে থাকে। বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা এখন আর কোনো ঘটনা নয়। যেমন একবার অ্যাডওয়ার্ড কেনেডিকে, প্রফেসর ওয়াল্টার মারফিকে প্লেনে উঠতে দেয়া হয়নি, কারণ সন্ত্রাসী লিস্টে তাদের নাম ছিল। তেমনিভাবে ফ্যাসিবাদী কোনো সরকার ক্ষমতায় গেলে তাদের পন'ী সব অপরাধীকে ছেড়ে দেয়, এমনকি ফাঁসির আসামিকে। অথচ তার চেয়ে কম অপরাধী বা নিরপরাধ সমালোচকেরা ছাড়া পায় না। যেকোনো সরকার এমন ব্যবহার করলে বুঝতে হবে তারা প্রকৃতই ফ্যাসিবাদী। তবে তারা যে লিস্ট তৈরি করে, তা কখনো পুরনো হতে দেয় না।
(৭) ফ্যাসিবাদীর আর একটি পদক্ষেপ হলো বিরোধী, সমালোচক, অধিকারের দাবি এবং নিরপেক্ষ জননন্দিত মানুষদের লক্ষ্যবস' করা। গভীরভাবে তাদের পাহারা দেয়া। এরা ক্ষমতায় গেলে প্রথমেই রাষ্ট্রীয় অঙ্গে অনুগত স'াপনে ব্যস্ত হয়। যথাসম্ভব প্রশাসন, শিক্ষাসহ সব জায়গা থেকে নিরপেক্ষ ও বিরোধী মনোভাবাপন্নদের অনৈতিকভাবে বহিষ্কার করা হয়। যেমন মার্কিন সরকার আটজন আইনজ্ঞকে চাকরিচ্যুত করল, কারণ তাদের রাজনৈতিক আনুগত্য স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বে এই ফ্যাসিবাদী ব্যবস'া ভয়াবহ। হাজার হাজার কর্মচারীকে বিদায় দেয়া হয়।
(৮) ফ্যাসিবাদের অষ্টম পদক্ষেপ হলো সংবাদমাধ্যমকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা। এটা প্রয়োজন এ জন্য যে, জনগণকে অন্ধকারে রেখে তাদের নিজেদের অ্যাজেন্ডা এগিয়ে নেয়া। এখন উন্নত বিশ্ব ও অন্য বিশ্বে প্রায় একই চিত্র। শুধু পার্থক্য হলো ওপরের পালিশ। বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম বন্ধসহ নানা বিধিনিষেধের কথা সবার জানা। ফ্যাসিবাদীরা মিথ্যা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা কতটুকু পানি ঘোলা করা গেল তার ওপর জোর দেয়। আসলে এখন বিশ্বব্যাপী কোথাও নির্ভেজাল সত্য খবর পরিবেশন করা বিপজ্জনক অথবা অসম্ভব হয়ে গেছে। এটা ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
(৯) প্রতিবাদ মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ। ফ্যাসিবাদের এই নীতি এখন সবাই সাদরে গ্রহণ করেছে। নানা আকারে এবং যুক্তি দিয়ে প্রতিবাদকে সন্ত্রাস, রাষ্ট্রদ্রোহ, দেশের শত্রু, জনগণের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। নাওমি উলফ বলছেন, প্রতিবাদকে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং সমালোচনাকে গোয়েন্দাগিরি হিসেবে এর মধ্যেই উপস'াপনা করা হয়েছে। তার কথামতো সাধারণ মানুষের জন্য বিচারের দরজা ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যদিও সবই আছে- সংবাদপত্র, আদালত, টিভি ও রেডিও, এমনকি সুশীলসমাজ। কিন' কোথাও সত্যিকারের প্রতিবাদ নেই, স্বাধীনতা নেই।
(১০) ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় নীতি হলো আইনের শাসনকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা। ক্ষমতাবানেরা ক্রমান্বয়ে তাদের ক্ষমতার বলয় আইনগতভাবে এমন বাড়িয়ে নিয়েছে যে এখন আইনের শাসন বলতে কিছু নেই। সবচেয়ে ভীতিকর বিষয় হলো সারা বিশ্বের মানুষকে প্রায় বাধ্য করা হয়েছে যে অধিকার দুই রকমের। যারা ক্ষমতায় আসীন তাদের জন্য আইন ও অধিকার তাদের প্রয়োজনে। কিন' সাধারণ মানুষের জন্য আইন নিজেই অসহায়। এ আইন পরিচালনা করে সরকারের পেটোয়া বাহিনী, অনুগ্রহীতের দল। এ দল কারা? জর্জ বার্নার্ড শ নাজিদের জন্য একটা চমৎকার সংজ্ঞা দিয়েছিলেন তিনটি শব্দ দিয়ে। সুশীল, বুদ্ধিমান ও নাজি। যদি কেউ সুশীল ও নাজি হয় তাহলে সে বুদ্ধিমান হবে না। কেউ বুদ্ধিমান ও নাজি হলে সে সুশীল হবে না। আর যদি কেউ সুশীল ও বুদ্ধিমান হয়, সে নাজি হতে পারবে না। বার্নার্ড শ-এর এই সংজ্ঞা যদি বাংলাদেশের সরকারি দলের কর্মীসহ তৃতীয় বিশ্বের সরকারি দলের কর্মীদের ব্যাপারে আরোপ করা হয়, তাহলে আজকের শুদ্ধ রাজনৈতিক কর্মীদের এবং ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক কর্মীদের ব্যাপারে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস ম্যাডিসন এক লেখায় বলেছিলেন, যদি সব ক্ষমতা, আইন প্রণয়নকারী, প্রশাসনিক ও বিচারিক যদি একই হাতে (অথবা গোষ্ঠী বা দলে) থাকে, তাকে নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচারের প্রকৃষ্ট সংজ্ঞা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
এখন গণতন্ত্রকামী বলে পরিচিতরা প্রায়ই জনকল্যাণ নয়, আত্মকল্যাণে রত থেকে ফ্যাসিবাদের দশ পদক্ষেপে ব্যস্ত থাকছে। ফলে মানবতা, ন্যায়বিচার বিশাল হুমকির মধ্যে পড়েছে।